মঙ্গলবার, ২৬ জুন, ২০১২

কুরআন-হাদীছের আলোকে শবে বরাত - পর্ব ০৮


بسم الله الرحمن الرحيم
মহাগ্রন্থের ২৫ তম পারা ও ৪৪ নং সূরা দুখানের শুরুতে যে পাঁচটি আয়াত রয়েছে সে আয়াতগুলোই লাইলাতুল বারাআত বিষয়ক আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দুতাই আয়াতগুলো প্রথমে অর্থসহ পেশ করা হচ্ছে

حم وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ أَمْرًا مِّنْ عِندِنَا ۚ إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ
হা মীম (এ অক্ষরদুটি হরূফে মুকাত্ত্যিয়াত বা বিকর্তিত বর্ণ যার অর্থ আল্লাহই ভাল জানেন) শপথ প্রকাশ্য কিতাবেরনিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতেনিশ্চয়
আমি সতর্ককারীএ রাতে প্রত্যেক জ্ঞানপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে আমিই প্রেরণকারী
(
সূরা দুখানঃ ১-৫ )

আয়াতে উল্লেখিত ليلة مباركة লাইলাতুম মুবারাকাহ (বরকতময় রাত) শব্দের ব্যাখ্যা বা তাফসীরকে কেন্দ্র করেই কুরআনের দৃষ্টিতে লাইলাতুল বারাআত শীর্ষক আলোচনার সূত্রপাত
গত পর্বে আমরা তাফসীর বিরোধ মীমাংসার প্রথম নীতি تطبيق তাতবীক তথা সামঞ্জস্যসাধন আলোকপাত করেছিলাম এবং এই নীতিমালার আলোকে মুফাসসিরে কেরাম ও উলামায়ে উম্মতের মতামত উল্লেখ করেছিলাম এই নীতিমালার আলোকে অধিকাংশ উলামায়ে কেরামই লাইলাতুম মুবারাকার তাফসীরে শবে বরাতকে সম্ভাব্য গ্রহণযোগ্য মত বলে রায় দিয়েছেন
এই পর্বে আমরা তাফসীর বিরোধ মীমাংসার দ্বিতীয় নীতিমালা ( ترجيح ) তারজীহ তথা প্রাধান্যদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব এবং এই নীতিমালার আলোকে মুফাসসিরে কেরাম ও আলেম উলামার মতামত উল্লেখ করব

দ্বিতীয় নীতিমালা ( ترجيح ) তারজীহ তথা প্রাধান্যদান
লাইলাতুম মুবারাকাহর উভয় ব্যাখ্যার সমাধান কল্পে দ্বিতীয় নীতিমালা তারজীহ ترجيح অর্থা অগ্রাধিকার ভিত্তিতেও দেয়া হয়েছেঃ
এ পদ্ধতিতেও একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে, নিম্নে তা পেশ করা হলোঃ

প্রথম মতামত
কারো কারো মতে সুরা দুখানের আয়াতে লাইলাতুম মুবারাকাহর ব্যাখ্যা দ্বয়ের মধ্যে শবেবরাত এর ব্যাখ্যাটাই প্রাধান্যতা পায় এবং এটাই নির্ভরযোগ্য মত কারণ এখানে (লাইলাতুম মুবারাকাহ) বরকতময় রাতটির দুটি বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছেএকটি হলো, পবিত্র কুরআনের অবতরণ ( انا انزلناه ) অপরটি হলো জ্ঞানপূর্ণ বিষয়সমূহের নির্ধারণ বা পৃথক করণকুরআন অবতরণ বলতে যদি অবতরণের সিদ্ধান্ত ধরে নেয়া হয় তাহলে এ বৈশিষ্ট্যটি শবে বরাতের ব্যাপারে সম্পূর্ণ প্রযোজ্য কিন্তু দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি একমাত্র শবে বরাতের জন্য প্রযোজ্যশবে ক্বদরের ব্যাপারে তা প্রযোজ্য নয় কারণ অধিকাংশ হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, শবেবরাত ভাগ্য নির্ণয়ের রাতযা বহু তাফসীর গ্রন্থে হযরত ইকরামাহ এর তাফসীরে দলীল স্বরূপ পেশ করা হয়েছেএবং বহু হাদীছ এ ব্যাপারে সামনে পেশ করা হবেকিন্তু শবে ক্বদর সম্পর্কে ভাগ্য-নির্ণয়ের এবং জ্ঞানপূর্ণ বিষয়ের নির্ধারণ সম্বলিত তেমন কোন হাদীছ পাওয়া যায় নাঅতএব উভয় বৈশিষ্ট্যের দিকটাকে বিবেচনায় আনলে এখানে ليلة مباركة লাইলাতুম মুবারাকাহ এর ব্যাখ্যা শবে বরাত হওয়াই উত্তম সমাধান কেননা, এর ব্যাখ্যায় শবে ক্বদর মেনে নিলে শবে বরাতে ভাগ্য নির্ণয় সম্বলিত অনেক হাদীছকে বাদ দিতে হয়

এ কারণেই হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) যাওয়ালুস সিনাহ এবং দাওয়াতে উবুদয়্যিত পুস্তিকাদ্বয়ে উক্ত মতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ থেকে শবে বরাত উদ্দেশ্য
অনুরূপ শেখ মুহাদ্দিছে দেহলভী (রহঃ) তার স্বীয় গ্রন্থ মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ এবং মাজালিসুল আবরার গ্রন্থদ্বয়ে সূরা দুখানের আয়াতসমূহ থেকে শবে বরাত উদ্দেশ্য বলে সাব্যস্ত করেছেন
(
দেখুন মাজালিসুল আবরারঃ পৃ ১৭৭ )

আল্লামা আব্দুলহক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) ما ثبت بالسنة এর বিবরণটি নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
অধিকাংশ উলামাদের মতামত হলো, কুরআন অবতরণ ও প্রতিটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফয়সালা শবে ক্বদরে সম্পন্ন হলেও এসব বিষয় আরম্ভ হয়েছে শবে বারাত তথা মধ্য শাবানের রাতে
(
দেখুন হাকীকতে শবে বরাতঃ পৃ ৮ )

এ মর্মে হযরত থানভী (রহঃ) এর ওয়াজ ও তাবলীগের উপরোক্ত বিবরণটিও আরকেবার উল্লেখযোগ্যঃ
কুরআনের অবতরণ দুই বার হয়েছেএক রাতে অবতরণের হুকুম (সিদ্ধান্ত) হয়েছে, দ্বিতীয় রাত্রে তার বাস্তবায়ন হয়েছে ...
মোদ্দাকথা হলো সূরায়ে ক্বদরে কুরআন অবতরণের অর্থ হলো, অবতরণের বাস্তবায়ন আর সূরায়ে দুখানের অর্থ হলো কুরআন অবতরণের সিদ্ধান্ত যা শবে বরাতে হয়েছে
এসব উদ্ধৃতি দ্বারা বুঝা যায় যে, হযরত মুহাদ্দিসে দেহলভী ও হযরত থানভী (রহঃ) প্রমূখের ন্যায় মুহাক্কিক ফকীহে উম্মত সূরা দুখানের আয়াতের তাফসীরে শবে বরাতের ব্যাখ্যাকে মত ব্যক্ত করেছেনঅর্থা শবেবরাতকে ترجيح তারজীহ দিয়েছেন

উপরন্তু মাওঃ ইসলামুল হক্ব মুযাহেরী সাহেব তার হাকীকতে শবে বরাত কিতাবের অষ্টম পৃষ্ঠায় শায়খুল আদব হযরত আল্লামা এযায আলী (রহঃ) এর একটি বক্তব্য তুলে ধরে বলেছেন যে, এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত শায়খুল আদব (রহঃ) এর মতও শবেবরাতের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে

কারণ হযরত শায়খুল আদব (রহঃ) এক বয়ানে বলেছেনঃ
কিছু আকাবিরীনে উম্মতের কথা হলো, শবে বরাতের মধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ফজীলতের বিষয় রয়েছে এর মধ্যে একটি হলো জ্ঞানপূর্ণ বৃহ বিষয়ের সিদ্ধান্ত এরাতেই গ্রহণ করা হয় কুরআনে পাকে বলা হয়েছে, “ এ রাতে প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের চুড়ান্ত করা হয় ” (এর পর বলেন) হযরত শাইখ দেহলভী (রহঃ) মাছাবাতা বিসসুন্নাহ কিতাবে এ ব্যাপারে একটি সূক্ষ্ম বাক্য উচ্চারণ করেছেন। (এর পর তিনি শায়খ দেহলভীর উল্লেখিত বিবরণটি তুলে ধরেন। ) অতঃপর মাওঃ ইসলামুল হক বলেনঃ
এতে বুঝা যায়, হযরত শায়খুল আদব (রহঃ) এর মতামতও শবে বরাতের দিকে। ( কেননা, হযরত (রহঃ) فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ আয়াতের অর্থ শবে বরাত দিয়েই করেছেন এবং বলেছেন এ রাতে বৃহ কাজগুলোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে। )

তারজীহের দ্বিতীয় মতামত

পক্ষান্তরে সূরা দুখানের শব্দ ليلة مباركة লাইলাতুম মুবারাকাহ এর তাফসীর অধিকাংশ মুফাসসির ও মুহাদ্দিছ শবেক্বদর দিয়ে করেছেন
কুরআনের সুরায়ে ক্বদরের মর্ম এবং

القرآن فيه انزل الذى رمضان شهر
আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাখ্যাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেশ করেছেন কেননা, এ আয়াতে বলা হয়েছে, কুরআন রমজান মাসেই অবতীর্ণ করা হয়েছেআবার সূরা ক্বদরে আল্লাহ পাক বলেনঃ আমি নিঃসন্দেহে কুরআনকে শবে কদরে নাযিল করেছি দুআয়াতকে মিলালে অর্থ দাঁড়ায়, শবে ক্বদর নামক রাতটি রমজানে অবস্থিতএদিকে সূরা দুখানে বলা হয়েছে, আমি কুরআনকে এক বরকত পূর্ণ রাতে নাযিল করেছি তাহলে এ বরকতপূর্ণ রাতটি ঐ শবে ক্বদরই হবে যা রমজানে অবস্থিতসুতরাং কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও সূরার মর্মের দিকে তাকালে লাইলাতুম মুবারাকাহ থেকে যে শবে ক্বদর উদ্দেশ্য এটা অতি পরিষ্কার
তাই উপরোল্লেখিত ৮টি তাফসীর গ্রন্থের প্রায় সবকটি তাফসীরেই এ মতটিকে প্রাধান্য ও সর্বাধিক সঠিক বলে মত পেশ করা হয়েছেএ মতের পক্ষে রয়েছেন অধিকাংশ মুফাসসির ও মুহাদ্দিস যেমন ইমাম নববী, ইমাম ইবনে কাছীর, ইমাম কুরতুবী, আল্লামা মোহাম্মদ আল আমীন শিনক্বীতী এবং মুফতিয়ে আযম আল্লাম মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহঃ) সহ অনেকে

এ মতামতের প্রাধান্য প্রমাণে উদাহরণস্বরূপ কিছু তাফসীর গ্রন্থের বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) উভয় মতকে সবিস্তারে বর্ণনা করার পর বলেনঃ
মোবারক রাত বলতে শবে ক্বদর উদ্দেশ্যইকরামা (রহঃ) বলেছেন, মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্যতবে প্রথম ব্যাখ্যাটি অধিক বিশুদ্ধকেননা, কুরআন শরীফ শবে ক্বদরে অবতীর্ণ হওয়ার কথা পরিস্কারভাবে কোরআনে বিদ্যমান
(
কুরতুবীঃ খ ১৬, পৃ ৮৫ )

ইমাম ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেনঃ
যারা বলে যে, বরকতময় রাত বলতে মধ্য-শাবানের রাতকে বুঝানো হয়েছে; যেমন বর্ণিত হয়েছে হযরত ইকরামা (রহঃ) থেকে, তারা প্রকৃত সত্য থেকে দূরে অবস্থান করে, কারণ, রাতটি যে রমযানে অবস্থিত তা কুরআন সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে
(
তাফসীরে ইবনে কাছীরঃ খ , পৃ ২৪৫ )
আল্লামা আলুসী (রহঃ) রূহুল মাআনীতে বলেনঃ
বরকতময় রাত থেকে শবে ক্বদর বুঝানো হয়েছেযেমন এটি বর্ণিত আছে ইবনে আব্বাস (রঃ) কাতাদাহ, ইবনে জুবাইর, মুজাহিদ, ইবনে যাইদ এবং হাসান (রহঃ) থেকেএটি অধিকাংশ মুফাসসিরের ব্যাখ্যাবাহ্যিক প্রমাণাদি এদেরই স্বপক্ষে
(
রূহুল মাআনীঃ খ , পৃ ১১০ )
 
ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহঃ) বলেনঃ
বরকতময় রাত থেকে যারা মধ্য-শাবানের রাত বুঝেছেন, আমি তাদের নিকট কোন নির্ভরযোগ্য দলীল দেখি নাযদি এ ব্যাপারে রসূল (সঃ) থেকে সঠিকভাবে কিছু প্রমাণ পাওয়া যেত তবে এর চেয়ে উত্তম কথা আর কিছু নেই নতুবা বলতে হবে প্রথম মতটি (শবে ক্বদর) অধিক সত্য ও হক
(
তাফসীরে কবীরঃ খ ১৪, পৃ ২৩৯ )

ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রহঃ) বলেনঃ
বরকতময় রাতটি শবে ক্বদর অন্যরা বলেছেনঃ বরং সেটি মধ্য শাবানের রাতএর মধ্যে যারা বলেছেন, এর দ্বারা শবে কদর বুঝানো হয়েছে সেটি সঠিক কথা
(
দেখুন তাফসীরে তাবরীঃ খ ১১, পৃ ২২১ )

একটি পর্যালোচনা
এ সকল বিবরণের দ্বারা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ليلة مباركة লাইলাতুম মুবারাকাহ দ্বারা শবে কদর হওয়াটাই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত এ অধমের ধারণা মতেও অধিকাংশ মুফাসসিরগণের মতামতই সঠিক ও অধিক নির্ভরযোগ্য কেননা এটা তাফসীরের প্রধান মূলনীতি অর্থা কুরআনের তাফসীর কুরআন দ্বারাই করা হয়েছেআর ইকরামাহ ও কাতাদাহ প্রমূখের ব্যাখ্যাটি হাদীছের আলোকে এবং তাবেয়ীনের বিবরণের মাধ্যমে করা হয়েছে যা তাফসীরের দ্বিতীয় মূলনীতিসুতরাং অধিক নির্ভরযোগ্য তাফসীর হলো সূরা দুখানের শব্দ ليلة مباركة লাইলাতুম মুবারাকাহ থেকে উদ্দেশ্য শবে ক্বদর হওয়াযদিও শবে বরাত হওয়ারও সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করা যায় না

উল্লেখ্য, আমি আগেই বলেছি শরীয়তের মূল ভিত্তি চারটিতাই কোন বিষয়বস্তু কুরআন দ্বারা প্রমাণিত না হলে তার অর্থ এই নয় যে, বিষয়টি ভিত্তিহীন বরং দেখতে হবে শরীয়তের দ্বিতীয় মূল উস হাদীছে তা আছে কি না? ইনশাল্লাহ সামনে বহু সহীহ ও আমলযোগ্য হাদীস দ্বারা শবেবরাত যে প্রমাণিত তা অতি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করা হবেতাই শবে বরাতের আলোচনা সরাসরি কুরআনে নেই বলে তা অস্বীকার করা ও ভিত্তিহীন বলা যেমন অজ্ঞতা ও ভ্রষ্টতা তেমনিভাবে শবে বরাতের বিবরণ কুরআনে সুস্পষ্ট আছে মনে করাও এর নামান্তরএ বাস্তবতার কারণেই দেখা যায় যেসব সাহাবী লাইলাতুম মোবারাকাহ এর তাফসীর শবে ক্বদর দ্বারা করেছেন সে সব সাহাবী থেকেই আবার শবে বরাতের ফযীলত সম্বলিত হাদীছ পাওয়া যায়এর অর্থ হল যাঁরা লাইলাতুম মুবারাকাহ থেকে শবে ক্বদর বুঝেছেন তাদের কেউ শবে বরাতকেও অগ্রাহ্য ও ভিত্তিহীন মনে করেন নিবরং তার গুরুত্ব ও ফযীলতকে তারা স্বীকার করে নিয়েছেন এবং এ রাত্রে ইবাদাত বন্দেগী করে তার অপরিসীম ফজীলত অর্জন করেছেন

উক্ত দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, সূরা দুখানের শব্দ লাইলাতুম মুবারাকাহর ব্যাখ্যা শবে ক্বদর দ্বারা করার কারণে একথা কখনও সাব্যস্ত হয় না যে, শবে বরাত নামক পবিত্র কোন রাত শরীয়তে নেই এমন কেউ বুঝে থাকলে বা এ ধরণের উক্তি কেউ করে থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে হবে, এরা কুরআন, সুন্নাহ, শরীয়ত কিছুই বুঝে নাই অথবা সব বুঝেও তা অস্বীকার করে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার মাধ্যমে ইসলামের শত্রুদের পক্ষপাতিত্ব করছে

চমকার সমাধানঃ

সূরা দুখানের লাইলাতুম মুবারাকাহ এর নির্ভরযোগ্য তাফসীর যদি শবে ক্বদর হয়, তাহলে فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ অর্থা এই রাতেই মানুষের ভাগ্য-তালিকা বন্টন করা হয়-এর তাফসীর হবে কেননা, ভাগ্য তালিকা বন্টনের রাতকে রসূল (সঃ) এর হাদীছে শবে বরাত বলা হয়েছে, সুতরাং এ বাহ্যিক বিরোধের সমাধান কী হবে?

এতক্ষণের দীর্ঘ আলোচনায় আশা করি এর উত্তর সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে

এ প্রসঙ্গে শারেহুল হাদীছ আল্লামা মুল্লা আলী আল ক্বারী (রহঃ) এর বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরা হল, উক্ত প্রশ্নের সমাধান বক্তব্যটির মাধ্যমে চমকারভাবে ফুটে উঠেছেতিনি বলেনঃ
এ বিষয়ে তো কোন বিতর্ক নেই যে, শাবানের পঞ্চদশ রজনীতে প্রজ্ঞাময় বিষয়াবলীর ফয়সালা হয়, যেমন আয়েশা (রঃ) এর হাদীছ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায়হ্যাঁ, এতে সংশয় রয়েছে আয়াতে কারীমা

فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
দ্বারা শবে বরাত উদ্দেশ্য কি না? সঠিক কথা এটাই যে, এই আয়াত দ্বারা শবে বরাত উদ্দেশ্য নয়তখন আয়াতে কারীমা এবং হাদীছ দ্বারা এ কথাই বুঝা যায় যে, এ প্রজ্ঞাময় কাজ উভয় রাতেই আঞ্জাম দেয়া হয়ে থাকে উভয় রাতের অতিরিক্ত মাহাত্ম্য বর্ণনা করার জন্যএটাও সম্ভাবনা আছে যে, শাবানের পঞ্চদশ রজনীতে প্রজ্ঞাময় কাজগুলি আঞ্জাম দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে যা আগামী শবে ক্বদর পর্যন্ত পূর্ণ হতে থাকেতাছাড়াও এই সম্ভাবনা রয়েছে যে, এই কাজগুলোর ব্যবস্থাপনা এই রজনীতে সংক্ষিপ্ত আকারে দ্বিতীয় রজনীতে বিস্তারিতভাবে হয়ে থাকেএটাও হতে পারে যে, রাত্রিদ্বয় হতে একটিকে পার্থিব কাজগুলির সমাধানের জন্য নির্ধারণ এবং অন্যটিকে আখেরাতের কাজসমূহের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়
(
মিরকাত শরহে মিশকাতঃ ৩/১৯৫ )

আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে কুরআন সুন্নাহ ও শরীয়তকে বুঝা ও তার উপর আমল করার তৌফিক দান করুনআমীন

শেষ কথাঃ
কোরআনের দৃষ্টিতে লাইলাতুল বারাআত শীর্ষক আলোচনা গুলো ভালভাবে অনুধাবণ করলে আমরা বুঝতে পারি যে, লাইলাতুম মুবারাকার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হল শবে ক্বদর, যার পক্ষে অধিকাংশ মুফাসসিরে কেরামই রায় দিয়েছেনআবার একদল মুফাসসিরে কেরাম এর অর্থ করেছেন শবে বরাত, যে মতটিকে ভ্রান্ত বলারও অবকাশ নেই, তাই তো যেসব মুফাসসিরে কেরাম শবে ক্বদরকে অধিকতর সঠিক বলেছেন, তারাই আবার দ্বিতীয় সম্ভাব্যমত হিসেবে শবে বরাতকেও উল্লেখ করেছেনপরবর্তী পর্ব থেকে হাদীসের আলোকে শবে বরাত শীর্ষক আলোচনা শুরু করব এবং ইনশাল্লাহ প্রমাণ করব যে, সহীহ হাদীস দ্বারাই শবে বরাতের ফযীলত প্রমাণিত

আজ কোরআনে কারীমের কিছু আয়াত পেশ করে শেষ করব
আল্লাহ পাক বলেন,

وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
হে মুমিনগণ, তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তওবা করতাহলে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে” [সূরা নূর : ৩১]

وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِّمَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدَىٰ
আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল তার প্রতি, যে তওবা করে- বিশ্বাস স্থাপন করে, কাজ করে ও স পথে অবিচল থাকে” [সূরা তাহা : ৮২]

إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٍ فَأُولَٰئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ
"
আল্লাহ অবশ্যই সে সকল লোকের তওবা কবুল করবেন যারা ভুলভশত: মন্দ কাজ করে এবং সত্বর তওবা করেএরাই তারা যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন। [নিসা : ১৭]"

فَمَن تَابَ مِن بَعْدِ ظُلْمِهِ وَأَصْلَحَ فَإِنَّ اللَّهَ يَتُوبُ عَلَيْهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
সীমালঙ্ঘন করার পর কেউ তওবা করলে ও নিজেকে সংশোধন করলে আল্লাহ তার প্রতি ক্ষমাপ্রবণ হবেনআল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু” [মায়িদা : ৩৯]

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَّن تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الضَّالُّونَ
বিশ্বাস করার পর যারা সত্য প্রত্যাখান করে তাদের তওবা কখনো কবুল করা হবে নাএরাই পথভ্রষ্ট” [ইমরান : ৯০]

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَّمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًا
যারা বিশ্বাস করে ও পরে সত্য প্রত্যাখ্যান করে, আবার বিশ্বাস করে আবার সত্য প্রত্যাখ্যান করে, অতঃপর তাদের সত্য প্রত্যাখ্যান-প্রবৃত্তি বেড়ে যায় আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোন পথও দেখাবেন না [নিসা : ১৩৭]