بسم الله الرحمن الرحيم
হাদীছের আলোকে শবেবরাতের ফজীলত ও আমলসমূহঃ
ইতিপূর্বে শবেবরাতের শরয়ী প্রমাণ সম্পর্কে বারটি হাদীছ এবং এর সূত্র বা সনদ ও তার পর্যালোচনা সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিচ্ছেদে আমরা শবেবরাতের মাহাত্ন্য, বৈশিষ্ট্য, ফজীলত ও আমলসমূহ যা পবিত্র হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত সেগুলো সংক্ষেপে পেশ করা হচ্ছে।
হাদীছের আলোকে শবেবরাতের ফজীলত ও আমলসমূহঃ
ইতিপূর্বে শবেবরাতের শরয়ী প্রমাণ সম্পর্কে বারটি হাদীছ এবং এর সূত্র বা সনদ ও তার পর্যালোচনা সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিচ্ছেদে আমরা শবেবরাতের মাহাত্ন্য, বৈশিষ্ট্য, ফজীলত ও আমলসমূহ যা পবিত্র হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত সেগুলো সংক্ষেপে পেশ করা হচ্ছে।
হযরত আয়েশা (রঃ) হযরত নবী (সঃ) থেকে বর্ণনা করেনঃ
শবে বরাতে কি ঘটে এ সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রঃ) রসূল (সঃ) থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই রাতের কার্যক্রম হলো এই বছর যত (সন্তান) জন্মগ্রহণ করবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এই বছর যত (লোক) ইন্তেকাল করবে তা লিখা হয়। আর এই রাতেই বান্দাদের (সারা বছরের) কার্যাবলী (আসমানে) উঠানো হয় আর এই রাতেই নির্ধারিত রিযিক অবতীর্ণ হয়। তারপর আয়েশা (রঃ) জানতে চাইলেন যে হুজুর ! আল্লাহর রহমত ও করুণা ছাড়া কেউ কি বেহেশতে যেতে পারবে? রসূল (সঃ)
তিনবার বলেনঃ কখনো পারবে না। আয়েশা (রঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ হুজুর ! আপনিও না? জবাবে বললেনঃ আমিও একমাত্র তার দয়া ও রহমত ছাড়া জান্নাতে যেতে পারবো না (তিনবার বললেন)।
( মিশকাত শরীফ )
হযরত আতা বিন ইয়াসির (রঃ) হতে বর্ণিতঃ
যখন শাবানের পঞ্চদশ রজনী আগত হয়, তখন আল্লাহর পক্ষ হতে মালাকুল মউতকে একটা তালিকা দেয়া হয় এবং হুকুম করা হয় যে, এই তালিকায় যেসব মানুষের নাম লিপিবদ্ধ আছে তাদের প্রাণ হরণ কর। কোন বান্দা বাগিচায় গাছপালা লাগাচ্ছে, কেউ বিবাহ করছে, কেউ বা নির্মাণ কাজে ব্যস্ত আছে অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায় লেখা হয়ে গেছে।
( দেখুনঃ মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকঃ খ - ৪, পৃ - ৩২৭ )
শবে বরাতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাঃ
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রঃ), মুআয বিন জাবাল (রঃ), আমর বিন আস (রঃ), আবু মূসা আশআরী (রঃ), আবু হুরায়রা (রঃ), আউফ বিন মালেক (রঃ), কাছীর বিন মুররাহ (রহঃ) সহ বহু সাহাবায়ে কেরাম থেকে ইতিপূর্বে যে সব হাদীছ বর্ণিত হয়েছে প্রায় সবগুলোর সারাংশ হলোঃ
নবী করীম (সঃ) ইরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা শাবানের পনেরতম রাত্রে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং এই রজনীতে সকলকে ক্ষমা ও মাগফিরাত করে দেন কেবল মাত্র মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত।
অগণিত মুসলমানকে ক্ষমা করা হয় এ রাতেঃ
ইতিপূর্বে উল্লেখিত ৪ নং হাদীছে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত আয়েশা (রঃ) বর্ণনা করেছেন যার একাংশ হলোঃ
রসূল (সঃ) বলেনঃ নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ তাআলা শা'বানের পনেরতম রজনীতে প্রথম আসমানে শুভাগমন করেন এবং কালব গোত্রের বকরীগুলোর পশম পরিমাণ মানুষকে ক্ষমা ও মাগফিরাত করে দেন। ( তিরমিযী )
সূর্যাস্ত থেকে সকাল পর্যন্ত পুরস্কার দেয়ার ঘোষণাঃ
ইতিপূর্বে উল্লেখিত ১১ নং হাদীছে হযরত আলী (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে দেখা যায় যে, অন্যান্য রজনীতে রাতের শেষাংশে গুনাহ মাফের আহবান করা হয় কিন্তু শবে বরাতের বৈশিষ্ট্য যে, সূর্যাস্ত থেকে সারারাতব্যাপী এ আহবান বলবৎ থাকেঃ
হযরত রসূল (সঃ) ইরশাদ করেন, যখন শা'বানের পঞ্চদশ রজনী আগত হয় তখন রাতে নামায পড় এবং পরবর্তী দিনে রোযা রাখ। কেননা সূর্যাস্ত হওয়ার সময় হতে সুবহে সাদিক (ফযর) উদিত হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং এ আহবান করতে থাকেনঃ আছে কি কোন ক্ষমাপ্রার্থী আমি তাকে ক্ষমা করে দেব? আছে কি কোন রিযিক যাচনাকারী, আমি তাকে রিযিক দেব? আছে কি কোন বিপদগ্রস্ত, আমি তাকে বিপদ হতে পরিত্রাণ দেব? আছে কি কোন এমন কেউ, এমন কেউ ইত্যাদি।
( ইবনে মাজাহ, বায়হাকী )
শবেবরাতে রাত জাগরণের নির্দেশঃ
হযরত আলী (রঃ) হতে বর্ণিত উক্ত হাদীছ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, শাবানের পঞ্চদশ রজনীতে জাগ্রত থেকে অধিক হতে অধিক ইবাদত করাও মুস্তাহাব, রাত জেগে নফল নামায আদায় করুন, কুরআন তিলাওয়াত করুন, দুআ ও ইস্তিগফার করুন।
শবে বরাতে রসূলের দীর্ঘ সিজদায় নফল নামায আদায়ঃ
ইমাম বাইহাকী (রহঃ) স্বীয় গ্রন্থ শুআআবুল ঈমানে আলা ইবনে হারেস (রহঃ) সূত্রে বর্ণনা করেনঃ
হযরত আলা ইবনে হারেস (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত আছে, হযরত আয়েশা (রঃ) বলেছেন, রসূলুল্লাহ (সঃ) রাতে উঠে নামায পড়তে আরম্ভ করলেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন, আমার এ ধারণা হলো যে, তাঁর ওফাত হয়ে গিয়েছে। আমি এ অবস্থা দেখে উঠে গেলাম এবং তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল নাড়া দিলাম। সেটা নড়ে উঠল। (তখন) আমি ফিরে আসলাম যখন তিনি সেজদা হতে মাথা উঠালেন এবং নামায হতে অবসর হলেন, তখন বললেনঃ হে আয়েশা! অথবা হে হুমায়রা! তুমি কি এ ধারণা পোষণ কর যে, (আল্লাহর) নবী তোমাদের অধিকার ক্ষুণ্ন করেছেন? আমি (বিনীত কন্ঠে) বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কসম বিষয়টি এমন নয়। প্রকৃত বিষয় হলো আমার ধারণা হলো আপনার মৃত্যু হয়ে গিয়েছে। কারণ আপনি সিজদা অনেক দীর্ঘায়িত করেছেন। তিনি বললেন, জান, এটি কোন রাত? আমি বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সঃ) ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ এটি শাবানের পঞ্চদশ রজনী। আল্লাহ তাআলা এ রাতে স্বীয় বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান, ক্ষমা প্রার্থীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থার উপরই ছেড়ে দেন। তাদের বিষয়টি মূলতবী রাখেন।
প্রায় একই রকমের হাদীছ বাইহাকী শরীফেই বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা (রঃ) হতে বর্ণিত সে হাদীছে রসূল (সঃ) এ রজনীতে যে নামায পড়েছেন এবং দীর্ঘ সেজদায় পড়ে ছিলেন এবং সেজদা রত অবস্থায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ দোয়া করেছেন সেই কথাও উল্লেখ রয়েছে।
( দেখুনঃ শুআবুল ঈমানঃ খ-৩, পৃ-৩৮৪ )
উপরোক্ত হাদীছদ্ব্য় থেকে রসূলের কয়েকটি আমল প্রমাণিত হয়ঃ
১। এ রাতে রসূল (সঃ) বেশী বেশী নফল নামায আদায় করেছেন।
২। দীর্ঘ সেজদার মাধ্যমে স্বীয় প্রভূকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছেন।
৩। শবে বরাতের যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
৪। আল্লাহর নিকট দয়া, দোআ-প্রার্থনা করেছেন।
৫। গুনাহগারদের ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং অনুগ্রহ প্রার্থনাকারীকে অনুগ্রহ ও দয়া প্রার্থনা করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন।
তাই এ রজনীতে প্রত্যেক রসূল প্রেমিকের জন্য উপরোক্ত কাজ ও আমলগুলো আঞ্জাম দেয়া সঙ্গত কর্তব্য।
শবে বরাতে দু'আ ও তওবার মাধ্যমে গুনাহের মার্জনাঃ
হযরত আয়েশা (রঃ) কর্তৃক রসূল (সঃ) এর শবে বরাতে কবরস্থান গমণ এবং সেখানে রাত্রি জাগরণ প্রসঙ্গে একটি লম্বা হাদীছের একাংশে বর্ণিত আছেঃ
" অতঃপর প্রিয় নবী (সঃ) বললেনঃ হে আয়শা ! তুমি কি আমাকে আজকের রাতে নামাযে দণ্ডায়মান অবস্থায় অতিবাহিত করার অনুমতি দিবে? আমি (আয়শা) বললামঃ নিশ্চয়ই; আপনার উপর আমার পিতা-মাতা কোরবান হউক। অতঃপর তিনি দীর্ঘ সময় (নামাযে) দণ্ডায়মান থাকার পর দীর্ঘ একটা সিজদা করলেন। এমনকি আমার ধারণা হলো, তিনি ওফাত পেয়ে গেছেন। আমি তাকে স্পর্শ করার ইচ্ছা করলাম এবং তার পায়ের তলায় হাত রাখলাম তখন সামান্য স্পন্দন অনুভব হল। আমি আনন্দিত হলাম আমি তাকে সেজদা অবস্থায় এই দোআ পড়তে শুনলাম।
اعوذ بعفوك من عقا بك وأعوذ برضاك من سخطك، وأعوذ بك منك جل وجهك لا أحصى ثناء عليك أنت كما اثنيت على نفسك
'হে আল্লাহ ! তোমার ক্ষমার মাধ্যমে তোমার শাস্তি হতে আশ্রয় চাই। তোমার সন্তুষ্টির দ্বারা তোমার অসন্তুষ্টি হতে আশ্রয় চাই। তোমার করুণা দ্বারা আশ্রয় চাই তোমার ক্রোধ হতে। তোমার দিকেই ধাবিত হই। তুমি এমন, যেমন তুমি তোমার প্রশংসা করেছ।'
সকালে (যখন) আমি তাঁর সাথে আলোচনা করলাম তখন তিনি বললেনঃ হে আয়েশা ! তুমি এই দোয়া মুখস্থ করবে? আমি বললামঃ অবশ্যই। তিনি বললেনঃ শিখে নাও। আমাকে এই কলিমাগুলো জিবরাইল (আঃ) শিখিয়েছেন এবং সেজদা অবস্থায় এটি বার বার পড়তে বলেছেন। "
( বাইহাকী শুআবুল ঈমানঃ ৩/৩৮৪, হাদীছটি দুর্বল তবে অন্যসূত্রেও হাদীছটি বর্ণিত আছে। )
শবে বরাতে প্রভূর দরবারে দুআ ও প্রার্থনা করার ব্যাপারে আরো একটি হাদীছ উদ্ধৃত করা হলো।
হাদীছটি ইমাম বায়হাকী (রহঃ) শুআবুল ঈমান গ্রন্থে হযরত আয়শা কর্তৃক বর্ণনা করেছেন যার আংশিক বর্ণনা এখানে তুলে ধরা হলোঃ
" এক রাতে রসূল (সঃ) নামায পড়তে দাঁড়ালেন, তিনি সেজদা এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম তিনি ইন্তেকাল করে গেছেন...অতপর আমি কান পেতে শুনতে পেলাম যে, তিনি সিজদারত অবস্থায় এই দুআ করছেন
اعوذ بعفوك من عقا بك وبرضاك من سخطك اعوذ بك منك اليك لاأحصى ثناء عليك انت كما اثنيت على نفسك
যখন তিনি সেজদা হতে মাথা উঠালেন এবং নামায হতে অবসর হলেন তখন তিনি বললেনঃ হে আয়শা ! তুমি কি ধারণা করেছ যে, আল্লাহর রসূল (সঃ) তোমার অধিকার হরণ করেছেন? অতঃপর রসূল (সঃ) বললেন, হে আয়শা ! তুমি কি জান এটা কোন রজনী? হযরত আয়শা (রঃ) বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রসূল ভাল জানেন। রসূল (সঃ) বললেনঃ এটি শাবানের ১৫ তারিখের রাত। এ রাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করা হয়। দয়া প্রার্থীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হয়। তবে বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়। "
( দেখুনঃ বায়হাকী শুআবুল ঈমানঃ খ-৩, পৃ-৩৮৪ )
উপরোক্ত হাদীসদ্বয়ের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রসূল (সঃ) শবে বরাতে দীর্ঘ সময় ধরে দুআ ও প্রার্থনারত থাকতেন। তাই রসূল প্রেমিকদের কর্তব্য এ পবিত্র রজনীতে দুআ ও প্রার্থনার মধ্যে আত্ননিয়োগ করা।