বুধবার, ২ জানুয়ারি, ২০১৩

আল্লাহ’র ইবাদত বা দাসত্বের মাধ্যমেই বান্দার প্রকৃত মর্যাদা

 --------লেখায়-----আ স ম আহসান উল্লাহ আব্দুল্লাহ



আমরা আল্লাহর বান্দা। এটি সবার জানা। কিন্তু বান্দা শব্দটির সম্পর্কে কি আমরা কখনো চিন্তা-ভাবনা করেছি, যে এই শব্দটির মর্মার্থ কি? এর দ্বারা কি বুঝায়? বান্দা ফারসী শব্দ যার আরবী হচ্ছে ‘আব্দ’ অর্থাৎ দাস। তাই আমরা সকলে ইবাদুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা।


বান্দা বা দাসের কাজ হচ্ছে তার মালিকের দাসত্ব করা, গোলামী করা। মালিকের নিকট সেই দাসই সর্ব্বোৎকৃষ্ট, যে তার মালিকের সত্যিকারার্থে দাসত্ব করে, গোলামী করে। কিন্তু তাঁর অনেক বান্দা এমনও আছে যারা আল্লাহর দাসত্ব করে না, করতেও চায়না । দাসত্ব করা যে বান্দাদের কর্তব্য তা বিশ্বাস করেনা। অথচ পৃথিবীতে সে লোকটি যখন কোন অর্থশালী মানুষের নিকট কিংবা কোন কোম্পানীতে কাজ করে, তখন সে তাকে মালিক মনে করে, তাকে বিশ্বাস করে, তার আদেশ-নিষেধ শোনে ও মানে । এর কারণ স্বরূপ সে বলে বা মনে করে যে, তার এই মলিক তাকে কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেয়, তাই সে তার কাজ করে।

মনে রাখা দরকার, এই মালিক তখন বিনিময় দেয় যখন সে তার কাজ করে দেয় কিন্তু মহান আল্লাহ তো
তার সকল বান্দাদের অনেককিছু এমনিই দিয়ে থাকেন। সারা দিন সূর্যের আলো কে দেয়? বাতাস কে দেয়? অক্সিজেন কে দেয়? রিযিকের জন্য বা রুজির জন্য শারিরিক ও মানশিক শক্তি দেন? এ সবের কি তিনি কোন বিনিময় নেন ? কোন শর্তও কি আরোপ করেন? তা সত্যেও যদি কোন বান্দা মহান আল্লাহর দাসত্ব না করে, তাহলে সে অবশ্যই একজন অহংকারী এবং অত্যাচারী বান্দা।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম নিজেকে আল্লাহর দাস বলাকে মর্যাদার বিষয় মনে করতেন: জগতের শ্রেষ্ঠ আব্দ বা বান্দা হলেন শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি আল্লাহর দাসত্ব স্বীকারে কতখানি খাঁটি ছিলেন এবং নিজেকে আল্লাহর দাস বলতে তাঁকে কত পছন্দ করতেন তাঁর স্বীকারোক্তি নিম্নে দেখা যেতে পারে। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না যেমন খৃষ্টানেরা মারিয়াম পুত্রের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে। আমি তো কেবল তাঁর আব্দ (দাস) তাই তোমরা আমাকে বল: আল্লাহর দাস এবং তাঁর রাসূল।” [ বুখারী, অধ্যায়, আম্বিয়া, অনুচ্ছেদ নং ৪৮, হাদীস নং ৩৪৪৫]

অনুরূপ অনেক দুয়া’তে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন অযুর দুয়া’য় উল্লেখ হয়েছেঃ- “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন মাবূদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।” [ মুসলিম, অধ্যায়, পবিত্রতা অর্জন, অনুচ্ছেদ, ওযু শেষে মুস্তাহাব যিকর।]

প্রতি নামাযের তাশাহহুদেও তাই বলা হয়েছে, “আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান্ আবদুহু ওয়া রাসূলুহু”। অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়াকোন সত্য উপাস্য নেই এবং এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। [বুখারী, নং৮৩১]

অন্য দিকে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দাসত্ব তথা বন্দেগী কত নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন এবং তা পালন করতে তাঁকে কত মজা লাগতো, তা নিম্নের হাদীস দ্বারা উপলব্ধি করা যেতে পারে।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে কিয়াম করতেন (দীর্ঘক্ষণ ধরে নামায পড়তেন) যার কারণে তাঁর দুই পা ফুলে যেত। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নবীজীকে বললেন: আল্লাহর রাসূল, আপনি কেন এরূপ কেন করছেন? আল্লাহ তো আপনার আগের ও পরের গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন: “আমি তাঁর কৃতজ্ঞ প্রকাশকারী বান্দা হতে পছন্দ করবো না কি?” [বুখারী, অধ্যায়, তফসীর, নং ৪৮৩৭]

মহান আল্লাহ সারা জগতেরসৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টিকুলের মধ্যে ফেরেশতাগণ তাঁর সম্মানীত সৃষ্টি। তিনি তাদেরকে নূর বা জ্যোতি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের ‘আব্দ’ বা দাস বলেছেন। আল্লাহ বলেন: তারা তো তাঁর সম্মানিতবান্দা, তারা আল্লাহর আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে। [আম্বিয়া/২৬-২৭]

মহান আল্লাহ যাদের স্বয়ং প্রশংসা করেন, যাদের সম্মানিত বান্দা বলেন, যারা সরাসরি আল্লাহর আদেশ পান, আর তাদের যদি আল্লাহ তাআ’লা বান্দা বলে সম্বোধন করেন, তাহলে মানবকুলের জন্য সেই সম্বোধন বা সেই উপাধি সম্মানের পাত্র নয় কি? আল্লাহর ‘আব্দ’ আখ্যা পাওয়া যে কত মর্যাদার বিষয় আমরা তা তাঁর শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবীর সেই ঘটনার মাধ্যমে অবগত হতেপারি। যেই ঘটনাটি ছিল নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য বিরাট সম্মানের ঘটনা। যেখানে আল্লাহ স্বয়ং তাঁর প্রিয় নবীকে নিজের কাছে ডেকে নেন। জান্নাত ও জাহান্নাম দেখান। পাঁচ ওয়াক্ত নামায প্রদান করেন ইত্যাদি। সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আল্লাহ তাআ’লা তাঁকে আব্দ বা বান্দা বলে সম্বোধন করেন।

আল্লাহ তাআ’লা বলেন: “পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায়, (বায়তুল মাকদিস) যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্যে;তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।” [ ইসরা/১]

ইসরা এবং মিরাজ’ নামে প্রসিদ্ধ এই মর্যাদাপূর্ণ ঘটনাতেই উল্লেখ হয়েছে, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সপ্ত আকাশ পেরিয়ে ‘সিদরাতুল্ মুনতাহায়’ পৌঁছালেন, তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর খুবই কাছাকাছি হলেন এবং তাকে অহী করা হল।

অন্যস্থানে মহান আল্লাহসমস্ত নবীগণকেই আব্দ বলে সম্বোধন করেন। যেমনতিনি বলেন:
“আমার প্রেরিত বান্দাদের সম্পর্কে আমার এই বাক্য পূর্বেই স্থির হয়েছে যে, অবশ্যই তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে।” [সাফ্ফাত/১৭১-১৭২]

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেন; “আল্লাহর নিকট তোমাদের নাম সমূহের মধ্যে অধিকতর পছন্দনীয় নাম হচ্ছে, আব্দুল্লাহ এবং আব্দুর রাহমান”। (মুসলিম ২১৩২) এই নাম দুটি আল্লাহ তায়ালা নিকট বেশি পছন্দ হওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় ইসলামি পণ্ডিতগণ বলেছেন: এই নামদ্বয়ে আল্লাহর দিকে বান্দার দাসত্বের সম্বন্ধ রয়েছে এবং বান্দার মানানসই বিশেষণের স্বীকৃতি রয়েছে। [ফাত্হুল বারী ১০/৬৯৯]

আসলে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক হচ্ছে, খাঁটি দাসত্বের সম্পর্ক। আর মহান আল্লাহর সম্পর্ক বান্দাদের সাথে হচ্ছে, পূর্ণ আশিস ও অনুগ্রহেরসম্পর্ক।

কারণ বান্দা তাঁর দয়ায় অস্তিত্ব লাভ করেছে, তাঁর অনুকম্পায় ধরাধামে জীবনযাপন করছে এবং তাঁররহমতেই আখেরাতে নাজাত পাবে। এর পরেও অনেকের মনে হয়ত একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, দাসত্ব কিভাবে মর্যাদার বিষয় হতে পারে? এর উত্তরে আশা করি একটি জাগতিক উদাহরণপেশ করা সঙ্গত হবে। পৃথিবীতে যদি মানুষ কোন রাজা বা উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিত্বের সেবা করা অসম্মান মনে না করে; বরংসম্মান ও গর্ব মনে করে, তাহলে পূর্ণ রাজত্বের অধিকারী রাজাধিরাজ, মহাশক্তিশালী, মহা প্রতাপশালী, সৃষ্টিকুলের পর্যবেক্ষক ও রক্ষক, অতি দয়ালু ও দয়াবান মহান আল্লাহর দাসত্ব করা, সম্মানীয় হবে না কেন? গৌরবের বিষয় হবে না কেন?

মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কোরানে বলেছেন - “আমি জিন ও ইনসানকে কেবল এই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি যে, তারা সকলে কেবল আমার ইবাদত করবে। আমি তাদের নিকট হতে জীবিকা চাই না এবং এও চাই না যে তারা আমার আহার্য যোগাবে।”

তাই পরিশেষে মহান রাব্বুল্ আলামীনের নিকটপ্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের তাঁর সৎ বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করেন, খাঁটি ভাবে তাঁর দাসত্ব করার তাওফীক দেন, আমীন।