শনিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১২

“পিতা ও পুত্রের সকল ত্যাগই আল্লাহ’র জন্য, এটাই আমাদের কুরবানীর শিক্ষা”

------আ স ম আহসান উল্লাহ আব্দুল্লাহ

পবিত্র ঈদ-উল আযহার প্রধান ও বিশেষ আমল হলো কুরবানী, আর এই কুরবানীর মূল শিক্ষা হলো- মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালার মর্জির উপর, কোন প্রকার কুন্টাবোধ না করে, সম্পুর্নভাবে আত্নসমর্পন করা ।

হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন ১৩ বছর, ঠিক তখন মহান রাব্বুল আলামিন, হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতা হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে স্বপ্ন ওহীর মাধ্যমে স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরবানীর আদেশ করলে- হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আল্লাহ’র প্রেমে মশগুল হয়ে স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাইল
আলাইহি ওয়াসাল্লামের গলে তীক্ষ ছুরি চালনা করেন। ঠিক ওই মুহুর্তে মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা খুশি হয়ে, হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামের জায়গায় একটি বেহেস্তী দুম্বাকে কুরবান/কবুল করে নিলেন।

হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই আত্নত্যাগে মহান রাব্বুল আলামিন এতো বেশী খুশি হয়েছিলেন যে, তাঁদের এই আত্নত্যাগকে চিরজীবি করে রাখার জন্য- সচ্ছল মুসলমানদের জন্য, প্রতিবছর পছন্দের পশু কুরবানী করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন।

কিশোর বয়সে স্বীয় পিতা কর্তৃক পুত্রকে, আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য কুরবান করার এই মহৎ ঘটনার কথা মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা পবিত্র কালামে পাক কুরান-শারিফের সুরা সাফফাতে উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন- “অতপর  ইসমাইল যখন পিতার সাথে চলা-ফেরা করার বয়সে উপনিত হলেন, তখন ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন- হে বৎস ! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে তোমাকে আল্লাহ’র নামে যবেহ করেছি, এখন তোমার অভিমত কি? তিনি (হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন- আব্বাজান আপনাকে যাহা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাহাই করুন, আল্লাহ্‌ চাহেতো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের সাথে পাবেন” (সুরা সাফফাত-১০২)

এই কথা স্বীকৃত যে, পয়গাম্বরগনের স্বপ্নও ওহী বটে, তাই এটা শুধুমাত্র স্বপ্ন নয় বরং স্বীয় পুত্রকে আল্লাহ’র নামে কুরবান দেওয়ার জন্য, হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এটি আল্লাহ’র হুকুম। কিন্তু এই হুকুমটি সরাসরি কোন ফেরেস্তার মাধ্যমে নাযীল না হয়ে এটি স্বপ্নের মাধ্যমে হওয়ার কারন হলো- মহান আল্লাহ’র প্রতি হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য এর পুর্নপ্রকাশ।
হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম, মহান আল্লাহ’র প্রতি অত্যাধিক ভালোবাসার পরিপেক্ষিতে স্বপ্নাদেশের সরাসরি বাস্তবায়ন করতে পারে কিন্তু তথাপিও তিনি কেন পুত্র হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিমত জানতে চাইলেন? তার কারন- প্রথমত, তিনি পুত্রের পরীক্ষা নিয়ে দেখতে চেয়েছেন যে আল্লাহ’র প্রেমে হযরত ইসমাইল কতটুকু উত্তীর্ণ হয়, এবং দ্বিতীয়ত আল্লাহ’র প্রেমে স্বপ্নাদেশটি বাস্তবায়নের পথটি সহজ ও নিকন্টন করা।

ফলস্রুতিতে হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লামের যোগ্য উত্তরসুরী ও ভাবি পয়গাম্বর তার প্রমান তিনি দিয়েছেন। তিনি (হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বীয় পিতাকে জবাব দিয়ে বললেন- আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা পালন করে ফেলুন। এবং আল্লাহ’র প্রতি তারও অগাধ ভালোবাসার সাহসী মনভাবের ইঙ্গিত দিয়ে বললেন- আল্লাহ্‌ চাহেতো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাইবেন।

আল্লাহ’র প্রতি ভালোবাসার নিরিখে স্বীয় পিতার সাথে হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুনিদ্রিস্ট জবাবে – অত্যান্ত আদব ও বিনয়ের প্রকাশ ঘটে, যেমন তিনি প্রথম বলেছেন “আল্লাহ্‌ চাহেনতো (ইনশাল্লাহ)”। এটি বলে তিনি ব্যপারটি সম্পুর্ন মহান আল্লাহ’র হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত তিনি বলতে পারতেন আমাকে সবরকারী হিসাবে পাবেন কিন্তু তিনি বলেছেন- “আমাকে সবরকারীদের মাঝে পাবেন” তার মানে দুনিয়াতে আরো অনেক সবরকারী আছে, তাই সবর করার কৃতিত্ব শুধু ওনার একার নয়। চুড়ান্ত পর্যায়ের বিনয়ের মাধ্যমে তিনি অহংকারের বিন্দু নিশানাকেও দুরীভূত করেছেন।

অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়েই যখন আল্লাহ’র প্রেমেই আল্লাহ’র নির্দেশ পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এবং যখন মিনায় কুরবানীর স্থানে উপস্থিত হলেন, তখন ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় পিতাকে বললেন- আব্বাজান, আপনি আমাকে খুব শক্ত করে বেঁধে নিন, যাতে আমি বেশী চটফট করতে না পারি এবং আপনার পরিধেয় পোশাক আপনি সামলে নিন যাতে-আমার রক্তের ছিটা আপনার পোশাকে না লাগে, এতে আমার সওয়াব কম হবে ও আমার রক্তের দাগ দেখলে আমার মা আমার জন্য ব্যাকুল হবে, আর আপনার ছুরিটাও ধার করে নিন এবং তা আমার গলায় দ্রুত চালাবেন যাতে আমার প্রান সহজে বের হয়ে যায় কারন মৃত্যু খুবি কঠিন ব্যাপার। আর আপনি আমার মায়ের কাছে আমার সালাম বলবেন, যদি আমার জামা-কাপড় তাঁর কাছে নিয়ে যেতে চান তবে নিয়ে যাবেন হয়ত এতে তিনি কিছুটা শান্তনা পাবেন (সুবহানাল্লাহ)।

একমাত্র পুত্রের মুখে এসব কথা শুনে  যে পিতার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠিন ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে মহান আল্লাহ’র প্রেমে স্বীয় পুত্রকে জবাব দিলেন- প্রিয় বৎস, মহান মালিকের আদেশ পালনে তুমি আমাকে অত্যন্ত চমৎকার সাহায্য করেছো। এই কথা বলে তিনি পুত্রকে চুম্বন দিলেম এবং আশ্রুভেজা চোখে তাকে বেঁধে নিলেন, তারপর তাকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন, তাঁর গলে ছুরি চালালেন, অনেক চেস্টা করেও হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লামের গলা কাটতে পারছিলেননা, তখন আরো সজোরে ছুরি চালালেন আর এই মুহুর্তে মহান আল্লাহ্‌ ডাক দিয়ে বললেন- “ হে ইব্রাহিম, আপনি স্বপ্নকে সত্যে পরিনত করে দেখিয়েছেন” (সুরা সাফফাত-১০৫)
উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে আমাদের সকল পিতা-পুত্রকে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের সমাজের সকল পিতা-পুত্রের প্রতিও আল্লাহ্‌ কর্তৃক অনেক আদেশ-নিষেদ আছে যাহা পালন করা কোন কোন ক্ষেত্রে ফরজ ও কোন কোন ক্ষেত্রে ওয়াজিব।

আল্লাহ্‌ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুশির জন্য একজন সন্তানকে সঠিক মানুষ হিসাবে তৈরি করা এবং জান্নাতের পথে পরিচালিত করা প্রত্যেক পিতার একান্ত কর্তব্য। দুনিয়ার কোন প্রকার দয়ামায়া যেন গ্রাস করে এই কর্তব্য পালনে  বাধা না করে, সেই দিকে থাকতে হবে সুক্ষদৃষ্টি । যেকোন ত্যাগের বিনিময়েই আল্লাহর আদেশ শিরধায্য রেখে সন্তান সহ পরিবার পরিজনে, নিজের জীবনের সার্বিক দায়িত্ব পালনে পিতাকে নিতে হবে অগ্রনী ভুমিকা।

ঠিক তেমনি মহান আলাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খুশির জন্য পিতার সকল ইসলামিক আদেশ-নিষেদকে মেনে নেওয়াও সন্তানের কর্তব্য। পিতার-মাতার খেদমত, পরিবার-পরিজনের প্রতি নিদ্রিষ্ট দায়িত্ব পালন সহ জীবনের সকল কাজেই যেনো হয় আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জন, সেই জন্য সকল প্রকার ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

তাই আসুন, আমরা আমাদের দয়াময় মহান আল্লাহ ও প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসার পরিপেক্ষিতে, পিতা-পুত্রের, একে-অপরের প্রতি সার্বিক দায়দায়িত্ব গুলো পালনের মাধ্যমে- মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালার ও প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লামের সন্তুষ্টি অর্জন করবো এটাই আমাদের সকলে প্রতিজ্ঞা ও এটাই হোক আজকের কুরবানীর শিক্ষা।