লেখায় -----আ স ম আহসান উল্লাহ আব্দুল্লাহ
পবিত্র কোরআন হচ্ছে আল্লাহর এক মহা-নেয়ামত, ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের একমাত্র সহায়ক হাতিয়ার, ভয় ও দুশ্চিন্তা দূর করার মাধ্যম, স্রষ্টার সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের একমাত্র পথ, মুত্তাকিদের জন্য পথ-প্রদর্শক,পথের দিশা, পুঞ্জিভূত সম্পদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ সম্পদ, রোগাক্রান্ত অন্তরের আরোগ্যকারী, শয়তানের বিরুদ্ধে সবচাইতে শক্তিশালী মিত্র, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী।
১· ‘এ (কোরআন) সে-ই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই, এতে রয়েছে মুত্তাকীদের জন্য পথের দিশা” (সূরা বাকারা ২ আয়াত)।
২· “ হে মানুষ তোমাদের জন্য এসেছে উপদেশ তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এবং অন্তরে যা আছে তার নিরাময় আর মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত। বলুন, ”এ কোরআন আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত, অতএব তারা সবাই আনন্দিত হোক। তারা যা কিছু জমা করে এই কোরআন তাঁর চেয়ে অনেক উত্তম” (সূরা ইউনুছ ৫৭, ৫৮ আয়াত)।
৩· “রমজান মাসেই কোরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়াত, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী” (সূরা বাকারা ১৮৫ আয়াত)।
কোরআন পাঠ আল্লাহর নির্দেশঃ বর্তমান ফেতনা-ফ্যাসাদযুক্ত সময়ে আমাদের জীবন কোরআন কেন্দ্রিক হওয়া জরুরী। এ জন্য কোরআন পড়তে হবে আর কোরআন পড়া আল্লাহর আদেশ ও বটে!।
১· “আপনার প্রতি নাজিলকৃত কোরআন পড় ন এবং নামাজ কায়েম করুন” (সূরা আনকাবুত ৪৫ আয়াত)।
২· “আমি যাদের কিতাব দিয়েছি, তারা তা যথোপযুক্তভাবে পড়ে, তারা এর প্রতি নিষ্ঠা সহকারে ঈমান আনে” (সূরা বাকারা ১২১)।
সর্বোত্তম ব্যক্তি হতে হলেঃ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে স্ব স্ব অবস্থানেসম্মান জনকভাবে থাকর জন্য আমরা সচেষ্ট। আমরা চাই ভালো থকতে, সুখে-শান্তিতে থাকতে, সফল হতে, মর্যাদার সাথে বাঁচতে। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ব্যক্তি হতে হলে আমাদের করণীয় কি হওয়া উচিত এ সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশ হচ্ছে,
১· “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি তিনি, যিনি কোরআন শিক্ষা লাভ করেন ও কোরআনের শিক্ষা দান করেন (প্রচার করেন)” (বুখারী)।
২· “তোমরা ফরজ এবং কোরআন মজীদ শিক্ষা কর এবং লোকদিগকে শিক্ষা দাও” (মিশকাত)।
৩· “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ” (ইবনে মাজাহ)।
মুসলমান হিসাবে কর্তব্যঃ
ময়াদা পূর্ণ জীবন গঠনের জন্য মুসলমান নর-নারীর কোরআন শেখা, কোরআন পড়া, মুখস্ত করা, বুঝতে চেষ্টা আবশ্যকীয় কর্তব্য। কোরআন শেখা, পড়া ও বোঝার জন্য প্রত্যেক মুসলমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। এটা কোরআনের মৌলিক দাবিও বটে। প্রয়োজনে সমষ্টিগত উদ্যোগদও গ্রহণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, “ধীরে ধীরে সহীহ-শুদ্ধভাবে কোরআন পড়-তেলাওয়াত কর” (সূরা মুযামমিল আয়াত ৪)। কোরআন আমাদের ধর্মগ্রন্থ হলেও আমরা অনেকে যথাযথ নিয়মে, সহীহ শুদ্ধ কোরআন পড়তে পারি না, জানি না। ছোট কালে কোরআন শিখলেও নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে না পড়ায় আমরা অনেকে কোরআন পড়া ভুলে গেছি, অনেকে কোরআন পড়লেও আগের মত সহীহ হয় না, নিয়ম অনুযায়ী কোরআন পড়া হয় না। যারা ভুলে গেছি, তারা এখন সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, সহীহই ভাবে আবার কোরআন শেখার ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরী কর্তব্য। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোরআন শিক্ষা করে অতঃপর তা ভুলে যায়, কেয়ামতের দিন সে অঙ্গহীন রূপে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে” (আবুদাউদ)।
চ-এর স্থলে ছ-দিলে, চ-এর স্থলে ঋ-দিলে অর্থের পরিবর্তন হয়, নাম্বার পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে আমরা সচেতন। আরবী হরফ একটির স্থলে আরেকটি পড়লে কি নামায হবে? এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। অন্তত নামাজ উপযোগী সূরাগুলো-পড়াগুলো আমাদেরকে সহীহ করতেই হবে। কারণ নামাজের মধ্যে কোরআন ভুল পড়লে নামাজ হয় না। নামাজ ভঙ্গের ১৯টি কারণের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে নামাজে অশুদ্ধ তেলাওয়াত করা- অশুদ্ধ পড়া। যথাযথ নিয়মে নামাজ না পড়লে রাসূলের (সাঃ) হাদিস হচ্ছে, ‘সবচেয়ে বড় চোর হলো সেই ব্যক্তি, যে নামাযে চুরি করে। জিজ্ঞাসা করা হলো, কি ভাবে নামাযে চুরি করা হয়? রাসূল (সাঃ) বললেন, যথাযথভাবে রুকু সিজদা না করা ও সহীহ ভাবে কোরআন না পড়া” (আহমদ)।
শিক্ষিত, সামাজিক মর্যাদার অধিকারী আর সম্পত্তির মালিক হলেও কুরআনের জ্ঞান যাদের মধ্যে নেই, তাদের কে আল্লাহ নিরক্ষর আর মূর্খ হিসাবে কোরআনে উল্ল্যেখ করেছেন। এ ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে, “তাদের মধ্যে এমন কিছু নিরক্ষর-মূর্খ লোক আছে যারা মিথ্যা আশা ছাড়া কিতাবের কিছুই জানে না, তারা মুধু অমূলক ধারণাই পোষণ করে” (সূরা বাকারা ৭৮ আয়াত)।
অন্ধ অবস্থায় যাদেরকে কেয়ামতের দিন ওঠানো হবেঃ
সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, মর্যাদা পূর্ণ জীবন যাপন করা, সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হওয়া আর ট্রেনিং ও বিশেষ ট্রেনিং নেয়ারপরও ধর্ম পালনে উপেক্ষা করা, আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল থাকা, কোরআন না শিখা না পড়া আর কোরআন অনুযায়ী না চলা এক কথায় কোরআনের আয়াতকে ভুলে থাকার দুনীয়াবি এবং পরকালীন পরিনাম অত্যন্ত ভয়াবহ। এ ব্যাপরে আল্লাহর জলদ গম্ভীর ঘোষণা হচ্ছে, “আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং কেয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ অবস্থায় উঠাবো। সে বলবে, হে আমার রব! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? আমিতো দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন ছিলাম (পৃথিবীতে)।
আল্লাহ বলবেন এরইরূপেই আমার আয়াত সমূহ তোমার কাছে এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে ছিলে, আজ অনুরূপভাবে তুমিও বিস্মত হলে- তোমাকে ভুলে গেলাম” (সূরা তোহা ১২৪, ১২৫ ও ১২৬ আয়াত)।
কাজেই মুসলমান হিসাবে কোরআন শিখার কোন বিকল্প নেই। কোরআন শিখতেই হইবে।
ঈমানদার, মুসলমান হিসাবে আমকে যেমনি কোরআন শিখতে হবে, ধর্মের পথে চলতে হবে, তেমনি অধিনস্থদের কে কোরআন শিখানোর, ধর্মের পথে চালানোর দায়িত্ব ও আমার। পরিবার প্রধান, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব আর কতৃêত্বে থাকর পরও এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে তার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহর আগাম সতর্ক বাণী হচ্ছে “ যে দিন তাদের চেহারা দোজখের আগুনের মধ্যে উলট-পালট করা হবে, সেই দিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্য করতাম। তারা আরও বলবে, আমরা তো আনুগত্য করতাম আমাদের নেতাদের ও প্রধানদের। অতএব, তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের রব! তাই আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ শান্তি প্রদান করুন এবং তাদের প্রতি লানত করুন-মহা লানত” (সূরা আহজাব ৬৬-৬৮ আয়াত)।
কোরআন শেখার ও বোঝা কঠিন নয়, সহজঃ
যিনি আমাদের কে দয়া করে কোরআন দিয়েছেন তিনি অবশ্যই তা শিখতে পাঠ করতে, বুঝতে ও অনুসরণ করতে আমাদের মাঝে শক্তি আর যোগ্যতাও দিয়েছেন। আমরা আল্লাহর দয়া ও সাহয্য চেয়ে চেষ্টা করলে আল্লাহ অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন। আল্লাহ আমাদের জন্য কোরআন শেখা ও বোঝা সহজ করেছেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন “আমি কোরআন কে বুঝার জন্য সহজ করেছি-সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি? (সূরা আল কামার ১৭ আয়াত)।
আমরা সত্যিকারর্থে আল্লাহ বিশ্বাসি হলে কোরআন শেখার ও বোঝার ব্যাপারে আমাদের চেষ্টা, সাধনা, পরিশ্রম, আকাঙক্ষা ও ব্যাকুলতা কোথায়? মনে রাখতে হবে দৃঢ় ইচ্ছা, সংকল্প ও প্রচেষ্টা না চালালে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। কোরআন তার পাঠকারীর জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে এবং আল্লাহ তা কবুল করবেন বলে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এর পরও কি আমরা কোরআন শিখায় মনোযোগি হব না?
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
১। হযরত ওসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন,তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কোরআন শিক্ষা করেছে এবং অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে। (বুখারী)
২। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেন, কোরআনে পারদর্শী ব্যক্তি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতাগণের সমমর্যাদাভূক্ত। আর যে কষ্ট করে থেমে থেমে কোরআন পাঠ করে তার জন্য দ্বিগুন সওয়াব। ( বুখারী ও মুসলিম)
৩। হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেন,নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা এ কোরআনের কারনে এক দলকে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করবেন আর অন্য দলকে অধঃপতিত করবেন। অর্থ্যাৎ এক দল কোরআনকে নিজেদের জীবন বিধান হিসেবে মেনে নেয়ার কারনে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে। আর অন্য দল কোরআনকে জীবন বিধান হিসেবে না মানার কারনে হবে লান্ছিত ও অধঃপতিত।(মুসলিম)
৪। হযরত আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে বলতে শুনেছি “তোমরা বেশী বেশী করে কোরআন পাঠ কর,কেননা কাল ক্বিয়ামতের দিন কোরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে”। (মুসলিম)
৫। হযরত মা’আয জুহানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করেছে এবং তদনুযায়ী আ’মল করেছে, ক্বিয়ামতের দিন তার পিতাকে এমন এক টুপি বা মুকুট পরিধান করানো হবে য্র আলো সুর্যের আলোর চেয়ে অধিক উত্তম হবে,যদি তা তোমাদের ঘরে হতো। এখন যে ব্যক্তি এ কোনআন মোতাবেক আ’মল করেছে তার সম্পর্কে তোমাদের কি ধারনা ?।
(মুয়াত্তা,আহমদ ও আবু দাউদ)
৬। হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি কোআন পাঠ করেছে,অতঃপর তা ভালভাবে রক্ষনাবেক্ষন করেছে ,তারপর কোরআন নির্দেশিত হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম জেনেছে তাকে আল্লাহ সোবাহানু তা’আলা বেহেশতে প্রবেশ করাবেন । আর তার বংশের এমন দশজন লোক –যাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ,তাদের জন্য সুপারিশ কবুল করা হবে। ( আহমদ.তিৱমিযী, ইবনু মাজাহ ও দারেমী)
৭। হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব ( কোরআন) থেকে একটি হরফ পাঠ করেছে তার আ’মল নামায় ১০টি নেকী লিখা হবে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কোরআন পাঠ করার তৌফিক দান করুন আর সে মতে জীবন গড়ার তোফিক দান করুন। আমিন
কোরআনের অর্থ জানাও জরুরি
কোরআন তেলাওয়াত অর্থাৎ পড়ার উদ্দেশ্য কি কেবল শব্দ পড়া, না কি অর্থ বুঝে পড়া? রাসূল (সা·) বলেছেন, কোরআনের প্রতিটি অক্ষর পড়ার জন্য রয়েছে ১০টি নেকি। এটা কি অর্থ ছাড়া পড়ার জন্য, না কি অর্থসহ পড়ার জন্য, এটা কি আবার কেবল অর্থসহ বোঝার জন্য, না কি তা জীবনে প্রয়োগ করার জন্যও? আরবের লোকের মাতৃভাষা আরবি। তাই তারা আরবিতে লেখা কোরআন সহজে বুঝতে পারে। যেমন আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় লেখা কোন বই সহজেই বুঝতে পারি। কোরআন বাংলায় নাজিল হলে আমরা সহজে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থও বুঝতে পারতাম। উল্লেখ্য, আল্লাহ বলেছেন, রাসূলদের মাতৃভাষা অনুযায়ীই তাদের ওপর কেতাব ও সহিফা নাজিল হয়েছিল।
একটি বোতলভর্তি মধু ছিপি দিয়ে বদ্ধ। এখন এ বোতলটার বাইরের অংশ চুষলে বা বোতলটি মুখে লাগালে কি মধু খাওয়া হবে? উদ্দেশ্য তো মধু খাওয়া। তাই ছিপি খুলে মধু খেতে হবে। তেমনি অর্থসহ কোরআন পড়লে প্রকৃত কোরআন পড়া হবে। এবং তা হলেই হৃদয়-মন-কলব পরিপুষ্ট হবে।
রাসূল (সা·) বলেছেন, যে ব্যক্তি আ-রিকতা সহকারে কলেমা পড়ে সে অবশ্য বেহশতে যাবে। সাহাবারা আন্তরিকতার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন কলেমার বাক্য মানুষকে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হারাম ও অবৈধ কর্ম থেকে বিরত রাখবে তখন তা আন্তরিকতা সহকারে পড়া হবে।
রাসূল (সা·) এও বলেছেন, এমন দিন আসবে যখন ইসলামের কিছুই থাকবে না শুধু নাম ছাড়া ও কোরআনের বাহ্যিক রূপ ছাড়া। মুসলমানদের মসজিদগুলো হবে ভক্তি ও জ্ঞানশূন্য।
আল্লাহ কোরআনে (সূরা আনআম আয়াত ৫০) বলেছেন, ‘চক্ষুষ্মান ও অন্ধ কি সমান? তোমরা কি অনুধাবন করবে না?’ তেমনি সূরা মুহাম্মদ আয়াত ২৪-এ আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি ওরা কোরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে, না ওদের অ-র তালাবদ্ধ? তোমরা কি ভেবে দেখবে না? (কাসাস-আয়াত ৭১-৭২)।
এগুলো কি কোরআনের অর্থ ও তাৎপর্য জানার কথা বলে না? ইসলাম প্রথম পর্যায়ে আরব এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। পরে তা অন্যান্য ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রসার লাভ করে। অর্থ ছাড়া পড়লেই যদি প্রতিটি অক্ষরের জন্য ১০টি নেকি পাওয়া যায়, তাহলে অর্থসহ পড়লে কি অনেক বেশি নেকি পাওয়া যাবে না?
যে কোন বিবেকবান ব্যক্তি বলবেন, অবশ্য বেশি নেকি পাওয়া যাবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, কোন কোন ধর্মবিশারদকে দেখেছি, কেবল কোরআন শব্দ পড়ার কথা বলেন। অর্থসহ পড়ার জন্য তেমন তাকিদই দেন না। ফলে সুখ ও শান্তিময় জীবন (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক) নির্বাহের জন্য, সুষ্ঠু প্রশাসন, বিচার, অর্থনীতি ইত্যাদি ব্যবস্থার জন্য, উত্তম চরিত্র গঠনের জন্য শাশ্বত কল্যাণময় কোরআনে যে শত শত বিধিবিধান ও দিকনির্দেশনা রয়েছে, সেগুলো সম্বন্ধে আমরা অজ্ঞই থেকে যাই।
সমাজ থেকে তাই অসত্যতা, কুসংস্কার, কলুষতা, পঙ্কিলতা, অশান্তি, অস্থিরতা দূরীভূত না হয়ে বরং বেড়েই চলছে যদিও আমরা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদির বাহ্যিক অনুষ্ঠানাদি পালন করে যাচ্ছি। মানুষ কে, কোথা থেকে এসেছে, তাকে এবং এ বিশ্ব জগৎকে কে সৃষ্টি করেছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন, স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সৃষ্টির সঙ্গে মানুষের কি সম্পর্ক কি, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কি? সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি, এ জন্যই কি শেষ, নাকি মৃত্যুর পর আরেক জগৎ আছে, কারও কাছে মানুষের জবাবদিহিতা আছে কি ইত্যাদি অনেক মৌলিক, গূঢ়, সূক্ষ্ম ও জীবনধর্মী প্রশ্ন মনোজগতে জাগে। মানুষ যুগে যুগে এগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল ও অস্বচ্ছ ধারণা পোষণ করে আসছিল। এগুলোর অকাট্য, সত্য ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আমরা কোরআন পড়ে জানতে পারি। তেমনি কোরআনে প্রায় ৭০০টি বিজ্ঞানবিষয়ক আয়াত পড়লে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ব, সার্বভৌমত্ব, অসীমত্ব, বিশালত্ব, বিশ্বজগৎ পরিচালন প্রকৌশলী প্রভৃতি অবহিত হয়ে আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস দৃঢ়তর হয় এবং অনুগত্যে মাথা নত হয়ে আসে। তাই অর্থ জানা জরুরি।
পবিত্র কোরআন হচ্ছে আল্লাহর এক মহা-নেয়ামত, ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের একমাত্র সহায়ক হাতিয়ার, ভয় ও দুশ্চিন্তা দূর করার মাধ্যম, স্রষ্টার সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের একমাত্র পথ, মুত্তাকিদের জন্য পথ-প্রদর্শক,পথের দিশা, পুঞ্জিভূত সম্পদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ সম্পদ, রোগাক্রান্ত অন্তরের আরোগ্যকারী, শয়তানের বিরুদ্ধে সবচাইতে শক্তিশালী মিত্র, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী। ১· ‘এ (কোরআন) সে-ই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই, এতে রয়েছে মুত্তাকীদের জন্য পথের দিশা” (সূরা বাকারা ২ আয়াত)।
২· “ হে মানুষ তোমাদের জন্য এসেছে উপদেশ তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এবং অন্তরে যা আছে তার নিরাময় আর মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত। বলুন, ”এ কোরআন আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত, অতএব তারা সবাই আনন্দিত হোক। তারা যা কিছু জমা করে এই কোরআন তাঁর চেয়ে অনেক উত্তম” (সূরা ইউনুছ ৫৭, ৫৮ আয়াত)।
৩· “রমজান মাসেই কোরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়াত, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী” (সূরা বাকারা ১৮৫ আয়াত)।
কোরআন পাঠ আল্লাহর নির্দেশঃ বর্তমান ফেতনা-ফ্যাসাদযুক্ত সময়ে আমাদের জীবন কোরআন কেন্দ্রিক হওয়া জরুরী। এ জন্য কোরআন পড়তে হবে আর কোরআন পড়া আল্লাহর আদেশ ও বটে!।
১· “আপনার প্রতি নাজিলকৃত কোরআন পড় ন এবং নামাজ কায়েম করুন” (সূরা আনকাবুত ৪৫ আয়াত)।
২· “আমি যাদের কিতাব দিয়েছি, তারা তা যথোপযুক্তভাবে পড়ে, তারা এর প্রতি নিষ্ঠা সহকারে ঈমান আনে” (সূরা বাকারা ১২১)।
সর্বোত্তম ব্যক্তি হতে হলেঃ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে স্ব স্ব অবস্থানেসম্মান জনকভাবে থাকর জন্য আমরা সচেষ্ট। আমরা চাই ভালো থকতে, সুখে-শান্তিতে থাকতে, সফল হতে, মর্যাদার সাথে বাঁচতে। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ব্যক্তি হতে হলে আমাদের করণীয় কি হওয়া উচিত এ সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশ হচ্ছে,
১· “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি তিনি, যিনি কোরআন শিক্ষা লাভ করেন ও কোরআনের শিক্ষা দান করেন (প্রচার করেন)” (বুখারী)।
২· “তোমরা ফরজ এবং কোরআন মজীদ শিক্ষা কর এবং লোকদিগকে শিক্ষা দাও” (মিশকাত)।
৩· “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ” (ইবনে মাজাহ)।
মুসলমান হিসাবে কর্তব্যঃ
ময়াদা পূর্ণ জীবন গঠনের জন্য মুসলমান নর-নারীর কোরআন শেখা, কোরআন পড়া, মুখস্ত করা, বুঝতে চেষ্টা আবশ্যকীয় কর্তব্য। কোরআন শেখা, পড়া ও বোঝার জন্য প্রত্যেক মুসলমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। এটা কোরআনের মৌলিক দাবিও বটে। প্রয়োজনে সমষ্টিগত উদ্যোগদও গ্রহণ করতে হবে।
কোরআন কিভাবে
পাঠ করতে
হবেঃ
কোরআন আল্লাহর কালাম। কোরআন কিভাবে পাঠ করতে হবে এ ব্যাপরে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কোরআন সেইভাবে পাঠ করতে হবে, যেভাবে আমাদেরকে পাঠ করতে বলা হয়েছে রাসূল (সাঃ) যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন, যেভাবে তিনি পাঠ করেছেন এবং তাঁর সাথী-সাহাবীগণ (রাঃ) পাঠ করেছেন। এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, “ধীরে ধীরে সহীহ-শুদ্ধভাবে কোরআন পড়-তেলাওয়াত কর” (সূরা মুযামমিল আয়াত ৪)। কোরআন আমাদের ধর্মগ্রন্থ হলেও আমরা অনেকে যথাযথ নিয়মে, সহীহ শুদ্ধ কোরআন পড়তে পারি না, জানি না। ছোট কালে কোরআন শিখলেও নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে না পড়ায় আমরা অনেকে কোরআন পড়া ভুলে গেছি, অনেকে কোরআন পড়লেও আগের মত সহীহ হয় না, নিয়ম অনুযায়ী কোরআন পড়া হয় না। যারা ভুলে গেছি, তারা এখন সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, সহীহই ভাবে আবার কোরআন শেখার ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরী কর্তব্য। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোরআন শিক্ষা করে অতঃপর তা ভুলে যায়, কেয়ামতের দিন সে অঙ্গহীন রূপে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে” (আবুদাউদ)।
চ-এর স্থলে ছ-দিলে, চ-এর স্থলে ঋ-দিলে অর্থের পরিবর্তন হয়, নাম্বার পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে আমরা সচেতন। আরবী হরফ একটির স্থলে আরেকটি পড়লে কি নামায হবে? এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। অন্তত নামাজ উপযোগী সূরাগুলো-পড়াগুলো আমাদেরকে সহীহ করতেই হবে। কারণ নামাজের মধ্যে কোরআন ভুল পড়লে নামাজ হয় না। নামাজ ভঙ্গের ১৯টি কারণের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে নামাজে অশুদ্ধ তেলাওয়াত করা- অশুদ্ধ পড়া। যথাযথ নিয়মে নামাজ না পড়লে রাসূলের (সাঃ) হাদিস হচ্ছে, ‘সবচেয়ে বড় চোর হলো সেই ব্যক্তি, যে নামাযে চুরি করে। জিজ্ঞাসা করা হলো, কি ভাবে নামাযে চুরি করা হয়? রাসূল (সাঃ) বললেন, যথাযথভাবে রুকু সিজদা না করা ও সহীহ ভাবে কোরআন না পড়া” (আহমদ)।
শিক্ষিত, সামাজিক মর্যাদার অধিকারী আর সম্পত্তির মালিক হলেও কুরআনের জ্ঞান যাদের মধ্যে নেই, তাদের কে আল্লাহ নিরক্ষর আর মূর্খ হিসাবে কোরআনে উল্ল্যেখ করেছেন। এ ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে, “তাদের মধ্যে এমন কিছু নিরক্ষর-মূর্খ লোক আছে যারা মিথ্যা আশা ছাড়া কিতাবের কিছুই জানে না, তারা মুধু অমূলক ধারণাই পোষণ করে” (সূরা বাকারা ৭৮ আয়াত)।
অন্ধ অবস্থায় যাদেরকে কেয়ামতের দিন ওঠানো হবেঃ
সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, মর্যাদা পূর্ণ জীবন যাপন করা, সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হওয়া আর ট্রেনিং ও বিশেষ ট্রেনিং নেয়ারপরও ধর্ম পালনে উপেক্ষা করা, আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল থাকা, কোরআন না শিখা না পড়া আর কোরআন অনুযায়ী না চলা এক কথায় কোরআনের আয়াতকে ভুলে থাকার দুনীয়াবি এবং পরকালীন পরিনাম অত্যন্ত ভয়াবহ। এ ব্যাপরে আল্লাহর জলদ গম্ভীর ঘোষণা হচ্ছে, “আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং কেয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ অবস্থায় উঠাবো। সে বলবে, হে আমার রব! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? আমিতো দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন ছিলাম (পৃথিবীতে)।
আল্লাহ বলবেন এরইরূপেই আমার আয়াত সমূহ তোমার কাছে এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে ছিলে, আজ অনুরূপভাবে তুমিও বিস্মত হলে- তোমাকে ভুলে গেলাম” (সূরা তোহা ১২৪, ১২৫ ও ১২৬ আয়াত)।
কাজেই মুসলমান হিসাবে কোরআন শিখার কোন বিকল্প নেই। কোরআন শিখতেই হইবে।
ঈমানদার, মুসলমান হিসাবে আমকে যেমনি কোরআন শিখতে হবে, ধর্মের পথে চলতে হবে, তেমনি অধিনস্থদের কে কোরআন শিখানোর, ধর্মের পথে চালানোর দায়িত্ব ও আমার। পরিবার প্রধান, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব আর কতৃêত্বে থাকর পরও এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে তার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহর আগাম সতর্ক বাণী হচ্ছে “ যে দিন তাদের চেহারা দোজখের আগুনের মধ্যে উলট-পালট করা হবে, সেই দিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্য করতাম। তারা আরও বলবে, আমরা তো আনুগত্য করতাম আমাদের নেতাদের ও প্রধানদের। অতএব, তারাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের রব! তাই আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ শান্তি প্রদান করুন এবং তাদের প্রতি লানত করুন-মহা লানত” (সূরা আহজাব ৬৬-৬৮ আয়াত)।
কোরআন শেখার ও বোঝা কঠিন নয়, সহজঃ
যিনি আমাদের কে দয়া করে কোরআন দিয়েছেন তিনি অবশ্যই তা শিখতে পাঠ করতে, বুঝতে ও অনুসরণ করতে আমাদের মাঝে শক্তি আর যোগ্যতাও দিয়েছেন। আমরা আল্লাহর দয়া ও সাহয্য চেয়ে চেষ্টা করলে আল্লাহ অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন। আল্লাহ আমাদের জন্য কোরআন শেখা ও বোঝা সহজ করেছেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন “আমি কোরআন কে বুঝার জন্য সহজ করেছি-সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি? (সূরা আল কামার ১৭ আয়াত)।
আমরা সত্যিকারর্থে আল্লাহ বিশ্বাসি হলে কোরআন শেখার ও বোঝার ব্যাপারে আমাদের চেষ্টা, সাধনা, পরিশ্রম, আকাঙক্ষা ও ব্যাকুলতা কোথায়? মনে রাখতে হবে দৃঢ় ইচ্ছা, সংকল্প ও প্রচেষ্টা না চালালে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। কোরআন তার পাঠকারীর জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে এবং আল্লাহ তা কবুল করবেন বলে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এর পরও কি আমরা কোরআন শিখায় মনোযোগি হব না?
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
১। হযরত ওসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন,তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কোরআন শিক্ষা করেছে এবং অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে। (বুখারী)
২। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেন, কোরআনে পারদর্শী ব্যক্তি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতাগণের সমমর্যাদাভূক্ত। আর যে কষ্ট করে থেমে থেমে কোরআন পাঠ করে তার জন্য দ্বিগুন সওয়াব। ( বুখারী ও মুসলিম)
৩। হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেন,নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা এ কোরআনের কারনে এক দলকে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করবেন আর অন্য দলকে অধঃপতিত করবেন। অর্থ্যাৎ এক দল কোরআনকে নিজেদের জীবন বিধান হিসেবে মেনে নেয়ার কারনে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে। আর অন্য দল কোরআনকে জীবন বিধান হিসেবে না মানার কারনে হবে লান্ছিত ও অধঃপতিত।(মুসলিম)
৪। হযরত আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে বলতে শুনেছি “তোমরা বেশী বেশী করে কোরআন পাঠ কর,কেননা কাল ক্বিয়ামতের দিন কোরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে”। (মুসলিম)
৫। হযরত মা’আয জুহানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করেছে এবং তদনুযায়ী আ’মল করেছে, ক্বিয়ামতের দিন তার পিতাকে এমন এক টুপি বা মুকুট পরিধান করানো হবে য্র আলো সুর্যের আলোর চেয়ে অধিক উত্তম হবে,যদি তা তোমাদের ঘরে হতো। এখন যে ব্যক্তি এ কোনআন মোতাবেক আ’মল করেছে তার সম্পর্কে তোমাদের কি ধারনা ?।
(মুয়াত্তা,আহমদ ও আবু দাউদ)
৬। হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি কোআন পাঠ করেছে,অতঃপর তা ভালভাবে রক্ষনাবেক্ষন করেছে ,তারপর কোরআন নির্দেশিত হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম জেনেছে তাকে আল্লাহ সোবাহানু তা’আলা বেহেশতে প্রবেশ করাবেন । আর তার বংশের এমন দশজন লোক –যাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ,তাদের জন্য সুপারিশ কবুল করা হবে। ( আহমদ.তিৱমিযী, ইবনু মাজাহ ও দারেমী)
৭। হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব ( কোরআন) থেকে একটি হরফ পাঠ করেছে তার আ’মল নামায় ১০টি নেকী লিখা হবে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কোরআন পাঠ করার তৌফিক দান করুন আর সে মতে জীবন গড়ার তোফিক দান করুন। আমিন
কোরআনের অর্থ জানাও জরুরি
কোরআন তেলাওয়াত অর্থাৎ পড়ার উদ্দেশ্য কি কেবল শব্দ পড়া, না কি অর্থ বুঝে পড়া? রাসূল (সা·) বলেছেন, কোরআনের প্রতিটি অক্ষর পড়ার জন্য রয়েছে ১০টি নেকি। এটা কি অর্থ ছাড়া পড়ার জন্য, না কি অর্থসহ পড়ার জন্য, এটা কি আবার কেবল অর্থসহ বোঝার জন্য, না কি তা জীবনে প্রয়োগ করার জন্যও? আরবের লোকের মাতৃভাষা আরবি। তাই তারা আরবিতে লেখা কোরআন সহজে বুঝতে পারে। যেমন আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় লেখা কোন বই সহজেই বুঝতে পারি। কোরআন বাংলায় নাজিল হলে আমরা সহজে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থও বুঝতে পারতাম। উল্লেখ্য, আল্লাহ বলেছেন, রাসূলদের মাতৃভাষা অনুযায়ীই তাদের ওপর কেতাব ও সহিফা নাজিল হয়েছিল।
একটি বোতলভর্তি মধু ছিপি দিয়ে বদ্ধ। এখন এ বোতলটার বাইরের অংশ চুষলে বা বোতলটি মুখে লাগালে কি মধু খাওয়া হবে? উদ্দেশ্য তো মধু খাওয়া। তাই ছিপি খুলে মধু খেতে হবে। তেমনি অর্থসহ কোরআন পড়লে প্রকৃত কোরআন পড়া হবে। এবং তা হলেই হৃদয়-মন-কলব পরিপুষ্ট হবে।
রাসূল (সা·) বলেছেন, যে ব্যক্তি আ-রিকতা সহকারে কলেমা পড়ে সে অবশ্য বেহশতে যাবে। সাহাবারা আন্তরিকতার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন কলেমার বাক্য মানুষকে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হারাম ও অবৈধ কর্ম থেকে বিরত রাখবে তখন তা আন্তরিকতা সহকারে পড়া হবে।
রাসূল (সা·) এও বলেছেন, এমন দিন আসবে যখন ইসলামের কিছুই থাকবে না শুধু নাম ছাড়া ও কোরআনের বাহ্যিক রূপ ছাড়া। মুসলমানদের মসজিদগুলো হবে ভক্তি ও জ্ঞানশূন্য।
আল্লাহ কোরআনে (সূরা আনআম আয়াত ৫০) বলেছেন, ‘চক্ষুষ্মান ও অন্ধ কি সমান? তোমরা কি অনুধাবন করবে না?’ তেমনি সূরা মুহাম্মদ আয়াত ২৪-এ আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি ওরা কোরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে, না ওদের অ-র তালাবদ্ধ? তোমরা কি ভেবে দেখবে না? (কাসাস-আয়াত ৭১-৭২)।
এগুলো কি কোরআনের অর্থ ও তাৎপর্য জানার কথা বলে না? ইসলাম প্রথম পর্যায়ে আরব এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। পরে তা অন্যান্য ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রসার লাভ করে। অর্থ ছাড়া পড়লেই যদি প্রতিটি অক্ষরের জন্য ১০টি নেকি পাওয়া যায়, তাহলে অর্থসহ পড়লে কি অনেক বেশি নেকি পাওয়া যাবে না?
যে কোন বিবেকবান ব্যক্তি বলবেন, অবশ্য বেশি নেকি পাওয়া যাবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, কোন কোন ধর্মবিশারদকে দেখেছি, কেবল কোরআন শব্দ পড়ার কথা বলেন। অর্থসহ পড়ার জন্য তেমন তাকিদই দেন না। ফলে সুখ ও শান্তিময় জীবন (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক) নির্বাহের জন্য, সুষ্ঠু প্রশাসন, বিচার, অর্থনীতি ইত্যাদি ব্যবস্থার জন্য, উত্তম চরিত্র গঠনের জন্য শাশ্বত কল্যাণময় কোরআনে যে শত শত বিধিবিধান ও দিকনির্দেশনা রয়েছে, সেগুলো সম্বন্ধে আমরা অজ্ঞই থেকে যাই।
সমাজ থেকে তাই অসত্যতা, কুসংস্কার, কলুষতা, পঙ্কিলতা, অশান্তি, অস্থিরতা দূরীভূত না হয়ে বরং বেড়েই চলছে যদিও আমরা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদির বাহ্যিক অনুষ্ঠানাদি পালন করে যাচ্ছি। মানুষ কে, কোথা থেকে এসেছে, তাকে এবং এ বিশ্ব জগৎকে কে সৃষ্টি করেছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন, স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সৃষ্টির সঙ্গে মানুষের কি সম্পর্ক কি, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কি? সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি, এ জন্যই কি শেষ, নাকি মৃত্যুর পর আরেক জগৎ আছে, কারও কাছে মানুষের জবাবদিহিতা আছে কি ইত্যাদি অনেক মৌলিক, গূঢ়, সূক্ষ্ম ও জীবনধর্মী প্রশ্ন মনোজগতে জাগে। মানুষ যুগে যুগে এগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল ও অস্বচ্ছ ধারণা পোষণ করে আসছিল। এগুলোর অকাট্য, সত্য ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আমরা কোরআন পড়ে জানতে পারি। তেমনি কোরআনে প্রায় ৭০০টি বিজ্ঞানবিষয়ক আয়াত পড়লে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ব, সার্বভৌমত্ব, অসীমত্ব, বিশালত্ব, বিশ্বজগৎ পরিচালন প্রকৌশলী প্রভৃতি অবহিত হয়ে আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস দৃঢ়তর হয় এবং অনুগত্যে মাথা নত হয়ে আসে। তাই অর্থ জানা জরুরি।