রবিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৩

ইসলামে ঈদ-এ-মিলাদুন্নাবীর ইতিহাস ও গুরুত্ব এবং ফজিলাত


.....আ স ম আহসান উল্লাহ আব্দুল্লাহ


মুসলিম বিশ্বে যেই দিনটি ও যেই মাসটি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপুর্ন, তা হলো ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আঊয়াল। যেহেতু এই দিনে আমাদের প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য রহমত হয়ে আগমন করেছেন।

ইতিহাস ও সীরাতের কিতাবাদি থেকে জানা যায়- হিজরি সপ্তম শতকের  প্রথম দিকে সর্বপ্রথম বর্তমান ইরাকের মসুল শহরের এক বিশিষ্ট বুজর্গ, হযরত শায়খ ওমর বিন মুহাম্মাদ ঈদ-এ-মিলাদুন্নাবীর মাহফিলের ব্যবস্থাপনা করেন। তারই অনুকরনে ইরবলের বাদশা মালিক মুজাফফর আবু সাইয়িদ রাষ্ট্রিয় ভাবে, ১২ই রবিউল আউয়াল ঈদ-এ-মিলাদুন্নাবী উৎযাপন শুরু করেন। বাদশা মালিক মুজাফফর আবু সাইয়িদের রাষ্ট্রিয় ভাবে ইদ-এ-মিলাদুন্নাবীর উনুষ্ঠানে, সে যুগের জ্ঞানী-গুনী, ও উলামায়ে মাশায়েখ নির্দ্বীধায় অংশগ্রহন করতেন।

ঈদ-এ-মিলাদুন্নাবী উৎযাপনের পক্ষে আন্তরিক সমর্থনে তত্ত্ব দিয়ে লেখেছেন- ঈমাম জালাল উদ্দিন সুয়্যুতি রাহমাতুল্লাহ আলাইহি, তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব- হাসানিল মাকসুদ ফি আমালি মাওলুদ। আল্লামা মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ, তাঁর কিতাব- সাবিলুল হুদা ওয়ার রাসাদ ফি সিরাতি খাইরিল ইবাদ। আল্লামা নুরুদ্দিন হলবী, তাঁর কিতাব- সীরাতে হলবীয়া। শায়খ আহমদ জয়নী, তাঁর কিতাব- সীরাতে নবুবীয়াহ। শায়খ আব্দুল খাত্তাব বিন দেহইয়াহ আন্দুলুসি, তাঁর কিতাব- আত তানবীর ফি মাওলিদিল বাশীর ওয়া নাযীর। মিশরের প্রখ্যাত আলেম- মোল্লা আলী কারী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি তাঁর কিতাব- আলমাওরিদুর রাবিউ ফি মাউলিদিন নাবী, এই গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন যে মুহাদ্দিসিন ও ওলামায়ে কিরাম এই পুন্য কাজটিকে অত্যাধিক পছন্দ করতেন।

উপরোল্লেখিত আলেমে মাশায়েখগন সহ শায়খুল ইসলাম আল্লামা হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী
রাহমাতুল্লাহ আলাইহি, বুখারী ও মুসলিম শরীফের একটি হাদিস দ্বারা দলিল সহকারে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে- সহিহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের মধ্যে সাবিত দলিলের উপর কিয়াসের ভিত্তিতে একথা স্পষ্ট যে, মীলাদ শরীফের অনুষ্ঠান একটি ভালো ও পছন্দনিয় কাজ।

তাছাড়া আরেকটু গভীর ভাবে লক্ষ করলে বুজতে সহজ হবে যে- শুধু মুসলিম বিশ্বে নয়, স্বয়ং মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের নিকট ও এই মাস ও এই দিনটির অনেক গুরুত্ব রয়েছে, কারন আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কোরানে কালামে বলেছেন- “হে হাবিব ! আমি আপনাকে যদি সৃষ্টি না করতাম, তবে এই আসমান-জমিন কিছুই সৃষ্টি করতামনা”।

হাদিসে কুদসিতে তিনি ঘোষনা দিয়েছেন- “হে হাবিব ! আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমার প্রতিপালকত্বকেও প্রকাশ করতাম না”। 

সুতারাং এই কথাই স্পষ্ট হল যে- আমাদের প্রিয় রাসুল হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সৃষ্টির কারনেই-আসমান-জমিন, লাওহ-কলম, আরশ-কুরসি, চাঁদ-সুরুজ, গ্রহ-তারা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষ-লতা, পশু-পাখি, জিন-ইনসান সহ সকল জাতির অস্তিত্ব প্রকাশ হয়েছে। কাজেই সঙ্গত কারনেই এই দিনটির গুরুত্ব সর্বস্তরে অত্যন্ত গুরুত্বের। তাই এই দিনটিকে কেন্দ্র করেই মুসলিম সমাজ ঈদ-এ-মিলাদুন্নাবী হিসাবে, অত্যন্ত তাৎপর্যের সাথে পালন করে থাকে।

আমি যদি ভুল না জেনে থাকি, তবে আমি জেনেছি- মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন বলেছেন- “হে হাবিব ! আপনি জানিয়ে দিন, আল্লাহ্‌ পাকের রহমত ও অনুগ্রহ অর্জিত হলে, তারা যেন আনন্দ উৎযাপন করে” এমন কি, যে ব্যাক্তি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত পাওয়ার পর আনন্দ হয়ে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে, মহান আল্লাহ্‌ তাকে খুশি হয়ে রাহমত আরো বৃদ্ধি করে দেন। এবং তাদের এ খুশি উৎযাপন করাটা, তাদের সমুদয় পুণ্য থেকেও উত্তম।(সুবহান আল্লাহ্‌)

তাই যেহেতু রাহমাতুল্লিল আলামিন আমাদের জন্য, মহান আল্লাহ’র পক্ষ থেকে এক বড় নেয়ামত ও রহমত, সেহেতু আমরা নবীপ্রেমিক মুসলমানগণ – মিলাদ-মাহফিল, ইসলামি আলোচনা, হামদ-নাত, দোয়া-দুরুদ, কোরান তেলাওয়াত, দান-খয়রাত, তাবারক বিতরন সহ সার্বিক পুন্য কাজের মাধ্যমে দিনটিকে উৎযাপন করে থাকি।

একটু খেয়াল করে দেখতে হবে- এই পৃথিবীতে আবহমান কাল থেকেই বিভিন্ন পীর-আউলিয়া, কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর জন্ম দিবস পালন করে, তাদের জীবনের বিভিন্ন দিগ আলোচনা করে থাকে, কিন্তু আমাদের প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের দিন উৎযাপন, তাদের মত তুলনা করা মোটেও উচিত হবেনা, বরং পাপ হবে। কারন পৃথিবীর সবাই কেও একটা জাতীর বা গোষ্টির, কিন্তু আমাদের প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র বিশ্বের ও সমগ্র জাতির।

তাই, নবীপ্রেমিক মুসলমানগণ সব সময় সতর্ক থাকতে হবে এই জন্য – যাতে কোন অবস্থায়, এই ঈদ-এ-মিলাদুন্নাবী উৎযাপন, আরো দশ জনের জন্ম দিবসের মত হই-হুল্লুড় করে বা অতিরঞ্জিত বাড়া-বাড়ি করে, হিতে বিপরিত কিছু না ঘটে। ঈদ-এ-মিলাদুন্নাবী উৎযাপনের থাকবে না কোন আতসবাজি, থাকবে কোন রঙের ছড়া-ছড়ি ও রঙ তামাসা। ঈদ-এ-মিলা্দুন্নাবী উৎযাপনের মাধ্যমে আমরা আলোচনা করে জানতে হবে- আমাদের প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে ছিলেন একজন শ্রেষ্ট পথ প্রদর্শক, দক্ষ রাজনৈতিক, সফল রাষ্ট্র নায়ক, সুশাসক, আদর্শ শিক্ষাদাতা, সৎব্যবসায়ী, নিরপেক্ষ বিচারক, নিপুন অর্থনীতিবিদ, ও সমাজ বিজ্ঞানী ইত্যাদি। ওনার এই সমস্ত গুনাবলির বিশদ আলোচনার মাধ্যমে আমরা শিক্ষা নিয়ে, আমাদের জীবনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের বাস্তয়নের আপ্রান চেষ্টা করতে হবে, তখনই এই ঈদ-এ-মিলাদুন্নাবীর সার্থকতা আসবে।

মনে রাখতে হবে- ১২ ই রবিউল আউয়ালের দিনটিকে ঈদ-এ-মিলাদুন্নাবী হিসাবে উৎযাপন করা, প্রকৃতপক্ষে একজন মুসলমানের ঈমানী চেতনা ও আধ্যাত্মিক মুল্যবোধের এক উজ্জ্বল ও অবিস্মরনীয় কর্মপন্থা। কাজেই এই দিনটিকে শুধু মাত্র গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না রেখে, এই দিনের তাৎপর্য উপলব্দি করে, তা আমাদের ব্যাক্তিগত জীবন, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিয় জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে হবে।