শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১২

“ধৈর্য” দিয়ে বিপদের মোকাবেলা করুন।


------আ স ম আহসান উল্লাহ আব্দুল্লাহঃ 
ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই আজ অশান্তির অসহয্য অগ্নিশিখার তাপদাহ পরিবেশে বাতাস ভারী হয়ে আসছে। বেকারত্বের অভিশাপ, অর্থসংকট, সম্পদহীন জীবন যেনো আজ দুর্বার ঘাসের মতো। অসহায়, অসহয্য সমস্যাগ্রস্ত জীবনের অস্থির ভাবনায় জীবন আজ বিভীষিকাময়। অস্থির মনে ছুটোছুটি। ভাবনার সমুদ্রে উত্তাল তরঙ্গ। এই অসয্য যন্ত্রনা থেকে মুক্তির উপায় আজ আমাদের অনেকেরই জানা নাই।

কিন্তু যিনি আমাদের কে অনেক দয়া করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সেই মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা  পবিত্র কুরআন শরীফে বাতলে দিয়েছেন কঠিন মুসিবতের সহজ সমাধান। মুমিনদের জন্য স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন“নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন
প্রতিনিয়ত আমরা চলার পথে জানা অজানা অসংখ্য বিপদের সম্মুখীন হই  জীবনের কঠিন বিপদগুলো কখনো কখনো আমাদের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে দেওয়ার মতো করে আসে। তখন মনে হয় আর

কতো ধৈর্য ধরবো ? শুরু হয় জীবনের হা-হুতাশ। ঠিক সেই সময়ে প্রত্যেক মুসলমানদেরকে মনে করতে হবেযতক্ষণ না আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিপদমুক্ত করছেনততোক্ষণই মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালার উপর অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা রেখে ধৈর্য ধারণ করে থাকতে হবে। কারন সকল বিপদের মুক্তি আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যের মধ্যেই নিহিত রেখেছেন।

ইতিহাস পড়লে জানা যাবেযুগে যুগে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বার বার ওনার প্রিয় বান্দাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছেন। সীমাহীন বিপদে আচ্ছন্ন রেখে তাদের ধৈর্যকে আরও মজবুত করেছেন। আল্লাহর এমন পরীক্ষাতে মুমিন মুসলমানেরা মোটেও বিচলিত হয়নি, দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দুঃখ প্রকাশ করেনি, ইসলামি জীবন-যাপন থেকে বিচ্ছুতি হয়নি বরং এই কঠিন পরীক্ষায় মুসলমানেরা মনের গভীরে ধারন করেছেন সেই আল্লাহকেইযিনি বিপদে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ আজকের সমাজে কোন কোন মুসলমানদের অবস্থা তার বিপরিতমুখী ।

কিন্তু না আমাদের কে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, আমরা মুসলমান, আমাদের ইসলামী শিক্ষা আছে, আমাদের পুর্ব-পুরুষদের ইতিহাস আমাদেরকে অনুপ্রানিত করে এবং আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ আমাদের জন্য সার্বিক সাবলীল শক্তি ও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের একমাত্র ভরসা। তাই জীবনের পাহাড়সম বিপদেও আমাদের কোন ভয় নাই।

মুসলমানদের জাতীর পিতা হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনী থেকে জানা যায়, কঠিন বিপদের সময় তিনি আল্লাহর ওপর আস্থা রেখে ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা দিয়ে তিনি
দারুণভাবে সফল হয়েছেন। এবং ধৈর্যের বিনিময়ে তিনি পেয়েছেনসুসজ্জিত ফুলের বাগানযা অত্যন্ত শান্তিময় এক স্থান। ইসলাম প্রচারের অপরাধে (!) তৎকালীন বিধর্মী জালিম শাসক নমরুদ হযরত ইব্রাহিমকে আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শূলে চড়াইতে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন, যেই শূলের নিচে স্থাপন করা হয়েছিল আগুনের উত্তপ্ত গর্ত। শূল থেকে তাঁকে জলন্ত অগ্নিময় এই গর্তেই ফেলা হবে। নমরুদের এই কুটকৌশলে শূলে চড়ানোর আগ পর্যন্তও হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধৈর্য শক্তিতে এতটুকু ফাটল ধরানো যায়নি এবং আল্লাহ বিরোধী কোনো কথাই বের করানো যায়নি ধৈর্যশীল মানব হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর মুখ থেকে। মহান রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ মতো ধৈর্য ধারণের ফলে আগুনের সেই গর্তকে তাঁর জন্য বানিয়ে দেওয়া হয়েছে নিরাপদ শান্তির স্থান।

হযরত ইয়াকুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সন্তান- হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হারিয়ে যখন শোকে বিহ্বলতখনও তিনি মহান আল্লাহর রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ মতোই ধৈর্যের সরণাপন্ন হলেন। দিনের পর দিন যায়মাসের পর মাস যায়, হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে আসে না। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও্রথয্রত ইয়াকুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যচ্যুত হননি। ধৈর্য পরীক্ষায় যখন তিনি উতরে গেলেনতখনই আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে দিলেন প্রিয় সেই সন্তান। এমন দৃষ্টান্ত অগণিত।

ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছে হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেও- বিনা অপরাধে দীর্ঘদিন তাঁকে জেলে পুরে রাখা হয়। চারপাশের মুক্ত পৃথিবী থেকে সরিয়ে রাখা হয় নির্দোষ এই নবীকে। তাই বলে কি তিনি চরম বিচলিতধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলেনমোটেও নাবরং অটল ধৈর্য নিয়েই প্রভুর কাছে প্রার্থনায় নিমগ্ন ছিলেন তিনি। আস্থা ছিলমহান দয়াময় আল্লাহই তাঁকে এই মিথ্যা জেল খাটুনি থেকে রেহাই দেবেন। ধৈর্যের এই পরিক্ষার ফল হিসাবে রেহাই তো তিনি পেলেনসেই সঙ্গে পেলেন মিশরের অধিপতির দায়িত্ব। এমনই ছিল ধৈর্য পরীক্ষার ফলাফল।

হযরত ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মা মরিয়াম (রা) কম ধৈর্য ধরতে হয়নি। আল্লাহর ইচ্ছায় মরিয়ম (রা) এর গর্ভে হযরত ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বাবা ছাড়াই এলেনতখন লোকে আঙ্গুল তুলে দেখাতে লাগলেন মরিয়ম (রা) এর দিকে। কী বিচ্ছিরি ব্যাপার ছিল সবার কাছে। কিন্তু মরিয়ম (রা) মুখ খুললেন না অজ্ঞ সমাজের কাছে। কেবল নিজের মতো করে মহান আল্লাহর উপর পুর্ন বিশ্বাস অ আস্থা রেখে ধৈর্য ধরে গেলেন। আর বললেনআল্লাহ! আমার ধৈর্য আরও বাড়িয়ে দাও। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাই করলেন। বিদ্রুপকারীরা একদিন ঠিকই বুঝতে পারল, হযরত ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো সাধারণ মানুষ ননতিনি আল্লাহর প্রেরিত নবী।

শেষপর্যন্ত আমাদের প্রানের নবী, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেস্ট নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জীবনের পরতে পরতে ধৈর্য ধরে গেছেন ইস্পাত কঠিনের মতো। শত বিপদের ঘোর আঁধারে মুহূর্তের জন্যও ধৈর্য থেকে সরে যাননি রাহমাতুল্লিল আলামীন তায়েফে্র ময়দানে কাফেরদের কাছ থেকে নির্যাতিত হওয়ার পরে আল্লাহ যখন তাঁর এই প্রিয় বন্ধুর কাছে বার্তা পাঠালেনতায়েফকে ধ্বংস করে দেওয়ার কথা বলে। তখনও তিনি অতিশয় ধৈর্য ধরেই বললেন, “ওরা তো বোঝে নাতাই অমন করেছে, ওদেরকে ক্ষমা করুন হে দয়াময়

পদে পদে বিপদের গর্ত মাড়িয়ে পার করতে হয়েছে দুনিয়ার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনতবু সবখানেই ছিল ধৈর্যের সরব উপস্থিতি। প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে আসাকাফেরদের সঙ্গে ক্ষুদ্র প্রস্তুতি নিয়ে ২৩টি যুদ্ধ পরিচালনা করাসুবিশাল কাফের গোষ্ঠির মধ্যে ইসলামের আলো জ্বেলে দেওয়াকাবা ঘরকে বেদ্বীনদের হাত থেকে মুক্ত করে আনা,ধৈর্যের পরীক্ষা কোথায় ছিল নাএমন ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন বলেই তো তাঁর ওপরই দেওয়া হয়েছিল মুসলিম উম্মাহর শেষ নবী ও রাসুলের দায়িত্বতাঁকেই করা হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। আর আমাদের জন্য আমাদের প্রিয় নাবীর সকল আদর্শকে করে দেওয়া হয়েছে, জীবন পরিচালনায় সার্বিক অনুকরনের একমাত্র মাধ্যম।

সুতরাং মুমিন মুসলমান হতে হলে ধৈর্যকেই সঙ্গী করতে হবে সবকিছুর আগে। শত বিপদে-আপদে, লাঞ্ছনা-বঞ্ছনায় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি তাঁর নির্দেশনা মানতে হবে ধৈর্যের সঙ্গেই। কোন প্রকার কষ্টেও অধৈর্য হয়ে সামান্যতম অন্যায়ের আশ্রয় নেওয়া যাবেনা। প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে কারো উপর নির্যাতন করা যাবেনা, এবং সার্বিক বিপদেও যদি মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালার উপর সম্পুর্ন বিশ্বাস রেখে ধৈর্য-ধারন করা যায় তবে সুফল হয়তো স্বচক্ষে দেখা যাবে নাকিন্তু ঠিকই লেখা হবে আল্লাহর কাছে, এবং সুফল আসবে জীবনে নিচ্ছিত

জীবনের সবখানে সব আয়োজনে আমাদের রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা ও তাঁর আদর্শের অনুস্নরন-অনুকরন এবং মহান দয়াময় আল্লাহর উপর আন্তরিক পুর্নভরশা রেখে- আল্লাহর নির্দেশিত এই ধৈর্যই হোক আমাদের জীবনের সকল বিপদ-আপদ থেকে উত্তোরণের একমাত্র উপায়।