শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১২

ইসলামের দৃষ্টিতে ঈদ-ঊল আযহা বনাম বর্তমান সমাজের ঈদ উৎসব

          ---------আ স ম আহসান উল্লাহ আব্দুল্লাহঃ
পবিত্র ঈদ-ঊল আযহার আনন্দ বার্তা নিয়ে যিলহজ্ব মাসের আগমন-মমিন মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। হজ্ব ও কোরবানির মাস হিসাবে যিলহজ্ব মাসের ফযিলত সম্পর্কে পবিত্র কোরান হাদিসে একাদিকবার উল্লেখ হয়েছে। মুমিন মুসলমানদের জন্য যিলহজ্ব মাস অত্যাধিক গুরুত্বপুর্ন হওয়ার কারন- এই মাসে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য মানব জাতির মুল ইবাদত গুলোর সমন্বয় ঘটানো হয়েছে, যেমন- এই মাসে নামাজ, রোজা,সদকা, হজ্ব সম্পাদন করা হয়, যাহা বছরের অন্যান্য সময়ে করা সম্ভব নয়। যার কারনে বিভিন্ন উলামায়ে কেরাম বলেছেন- যিলহজ্ব মাসের প্রথম ১০ দিন  সবচেয়ে উত্তম দিন এবং রমজান মাসের শেষ ১০ রাত সবচেয়ে উত্তম রাত। 

মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা অশেষ মেহেরবানী করে যেমনি আমাদেরকে এই দিন-রাত গুলো নেয়ামত হিসাবে দান করেছেন, ঠিক তেমনি ভাবে এই বিশেষ দিন গুলোতে বিশেষ ইবাদতের মাধ্যমে আল্লার সুন্তুস্টি অর্জনের কিছু নিয়মকানুনও নিদ্রিস্ট করে দিয়েছেন,
যেমন- আরাফার দিন ফজর থেকে যিলহজ্ব মাসের ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীরবলা (ইমাম
বুখারী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেছেন- ইবনে ওমর ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা যিলহজ্ব মাসের প্রথম ১০ দিন তাকবির বলতেন, এমন কি বাজারে যাওয়ার সময়ও যখন ওনারা তাকবির বলতেন তখন লোকজন তাদেরকে দেখে দেখে তাকবির বলতেন, ইবনে ওমর মিনায় তাঁর তাঁবুতে তাকবির বলতেন, মসজিদের লোকেরা তা শুনতো তারপর তারাও তাকবির বলতো, এক পর্যায়ে পুরা মিনায় তাকবিরের ধ্বনিতে মুখরিত হতো), আরাফার দিন রোজা রাখা ( মুসলিম শরীফের হাদিসে পাওয়া যায়- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আরাফার দিনের রোজা রোজাদারের পুর্ববর্তী একবছর ও পরবর্তী একবছরের গুনাহের কাফফারা হবে), ঈদের নামাজে এক রাস্তায় গিয়ে অন্য রাস্তায় ফেরত আসা (যাদের জন্য ঈদের নামাজে যাওয়া-আসার একটি মাত্র রাস্তা, তারা ঈদের জামাতে যাওয়ার সময় রাস্তার একপাশ দিয়ে যাবেন এবং আসার সময় অন্য পাশ দিয়ে আসবেন), কোরবানী করা, সুন্দর জামা-কাপড় পরিদান করা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা, একে অপরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করা, কোরবানের আগ পর্যন্ত চুল+ দাঁড়ী + নখ না কাটা, ঈদের নামাজের পর কোরবানীর গোস্ত তৈরী হওয়া পর্যন্ত কিছু না খাওয়া, কোরবানীর গোস্ত শরীয়ত সম্মত ভাবে গরীব-মেসকীনদের মাঝে বিতরন করা ইত্যাদি।
প্রত্যেক মুমীন-মুসলমানদের কর্তব্য ইবাদতের এই বিশেষ দিন গুলোতে বিশেষভাবে বেশী বেশী ইবাদত করা, গুনা ও আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকা এবং এই কল্যাণকর শুভদিন গুলোতে সার্বিকভাবে এমন সব কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখে আল্লাহর পথে সর্বত্নক প্রচেস্টা চালাতে হবে যাতে মহান দয়াময় রাব্বুল আলামিন আমাদের উপর সন্তুস্ট থাকেন।
যেহেতু আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কালামে পাক কোরান শরিফে বলেছেন- যারা আমার পথে সর্বাত্নক চেস্টা চালায়,  তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করবো (সুরা আনকাবূতঃ ৬৯) সেহেতু সাহাবায়ে কেরাম, উলামায়ে কেরাম সহ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী আল্লাহর সমস্ত নেয়ামতকে বুকে ধারন করে ঠিক সেইভাবেই ইসলামী জিন্দেগী পরিচালনা করেছেন, হয়েছেন আল্লাহ্‌ মুখী ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অকুতভয় প্রেমিক।
অথচ আজকের দিনে বর্তমান সমাজের ঈদ উৎসবের নানাদিক একটু গভীর ভাবে পরখ করলে দেখা যাবে-  দিন দিন আমরা আমাদের সেই ইসলামী চেতনা থেকে পিছিয়ে পড়েছি, ইসলামী মুল্যবোধ আজকের দিনে আমাদের আবেগের বেড়াজালে আবদ্ধ, ঈদের আগমনে সীমাহীন আনন্দ যেনো ভুলিয়ে দেয় ইসলামের সেই দিক নির্দেশনা।
নামাজের সময় ছাড়া কোন মুসল্লিকে তাকবীর দিতে দেখা যায়না, আরাফার দিনে কতজন মুসলমান রোজা রাখি অথচ ৯০% মুসলমানের দেশে আমাদের অবস্থান? নামের আগে হাজী সাহেব যোগ করতে হজ্ব করছি কিন্তু আমার পরিবারে কি নামাজ কায়েম করতে সক্ষম হয়েছি? কোরবান দেওয়ার প্রস্তুতিতে বিভোর কিন্তু কোরবান দেওয়ার টাকা কি সঠিক পথের রোজগার? আমার ছেলে-মেয়ের জন্য নতুন জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করালাম কিন্তু আমার ভাই-বন্ধুদের ছেলে-মেয়েদের কি অবস্থা তা কি একটু খোজ নিয়েছি ? নাম ফুটানোর জন্য বড় বড় গরু/উট কিনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছি কিন্তু আমি আমার যাকাতের অর্থ কি পরিশোধ করেছি? ইত্যাদি বিষয় গুলো আমরা এখন আর ভেবে দেখি কয়জনে?
কোরবানীর পর, কোরবানীর পশুর চামড়ার একমাত্র দাবীদার এলাকার গরীব-মেসকীন। কোরবানীর পশুর চামড়া ন্যয্যদামে বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ গরীব-মেসকীনদের মাঝে ইসলামী নিয়মে বিতরন করা কোরবান দাতার কর্তব্য। কোন অবস্থায় এর হেরফের করা চলবেনা, যেকোন কৌশলেই বা ক্রেতা-বিক্রেতার যোগসাজেশে যদি, কোরবানীর পশুর চামড়ার ন্যয্যদামের থেকে এক টাকাও কম নেওয়া হয় এবং তা দিয়েই গরীব-মেসকিনদেরকে বুজ দেওয়া হয় তবে তা হবে হটকারীতা এবং গরীব ঠকানোর অপরাধ।
কিন্তু বর্তমান সমাজের অনেক জায়গায় দেখা যায়- কোরবানীর পশু জবাই করার পর বিভিন্ন মসজিদ/মাদ্রাসার কর্তাব্যক্তি, কোরবানদাতার নিকট এসে বলে থাকেন- ভাই আপনার কোরবানের পশুর চামড়াটি আমাদের কে দিবেন, আমি আপনাকে ৫০০ টাকা দিবো, বর্তমান বাজারে এই চামড়াটির দাম যাহাই হোক আপনি আর দাবি রাখবেননা, কারন আমি এই চামড়ার লাভের টাকাটা আমার মসজিদের/মাদ্রাসার উন্নয়ন কাজে ব্যয় করবো। কর্তাব্যক্তির এই কথা শুনে হয়তো আমাদের অনেক মুসলমান ভাইয়েরা এটা মনে করেন যে- ভালোইতো চামড়ার টাকা যেহেতু আমরা পাচ্ছিনা সেহেতু দাম যাহাই পাই এটা গরীবদেরকে দিয়ে দিলাম, আর চামড়া সস্তায় দেওয়ার কারনে তার লাভের অংশ মসজিদ/মাদ্রাসার উন্নয়ন কাজে আসবে এতে মন্দ নয়!!! অথচ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, জেনে-নাজেনে এই কাজের মাধ্যমে গরীবকে ঠকানো হচ্ছে, গরীবের হক নিয়ে এই কুটকৌশলের জন্য কোরবানদাতা যেমনিভাবে অপরাধী হচ্ছেন  তেমনি ওনার কোরবান কবুল হওয়ার ব্যপারেও সন্দিহান।
অনেকে কোরবানের পশু জবাই করার পর, গোস্ত বানানোর আগেই জবাইকৃত পশুর কলিজা ভাগাভাগি করে নিয়ে যায় এই ভেবে যে, গোস্ত বানাতে আরো অনেক সময়ের দরকার তাই কলিজা ভাগ করে নিয়ে ভাজি করে রুটি দিয়ে খাওয়া যাক!!! অথচ এই কলিজাতেও গরিবের ও নিকটাত্মীয়ের হক আছে, যাহা সঠিক ভাবে বন্টন না করলে আমাদের জন্য পুরো গোস্ত নাজায়েয হয়ে যাবে এবং কোরবানের অর্থই অনর্থক হয়ে যাবে। ঠিক এভাবে অনেক অনিয়ম বর্তমান সমাজে প্রচলিত যাহা ইসলাম কোন ভাবেই সমর্থন করেনা।
তাই আসুন আমরা একটু গভীর ভাবে চিন্তা করি- মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের যে নেক হায়াত দিয়েছেন, তার বদৌলতে আমরা আজকের এই তাৎপর্যপুর্ন দিন গুলো পেয়েছি। আগামিতে আমরা এই নেকময় দিন গুলো নাও পেতে পারি। পবিত্র ঈদ আমাদের জন্য দ্বীনের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন, এর উজ্জ্বলতায় আমাদের সকলের জীবন যেনো হয় আলোকিত ইসলামী জীবন, সে জন্যই সমাজের উঁচুনিচু সকল ভেদাভেদ, হিংসা-হানাহানি ভুলে গিয়ে এবং আমাদের নিজস্ব অন্ধ আবেগ দূর করে ইসলামী দিক নির্দেশনায় ঈদ-ঊল আযহা উৎযাপন সহ এই পবিত্র তাৎপর্যপুর্ন দিন গুলোতে আমরা আমাদের সার্বিক কর্মসুচী, মহান আল্লাহ তায়ালা ও প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত করি।