বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

কুরআন-হাদীছের আলোকে শবে বরাত - পর্ব ১৩


بسم الله الرحمن الرحيم
হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ৫
গত তিন পর্বে আমরা শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত তিনটি হাদীস উল্লেখ করে সেগুলোকে সহীহ বা হাসান প্রমাণ করেছিলামযদি শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে আর কোন হাদীস না থাকত, তবে এই তিনটি হাদীসই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত
কিন্তু শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে আরও সহীহ বা হাসান হাদীছ বিদ্যমানএই পর্বে আমরা আরও একটি হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করব এবং সাথে সাথে এই হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের মতামত পর্যালোচনা করব

৪র্থ হাদীছ (حسن صحيح لغيره)
হযরত আয়শা (রঃ) বলেন, এক রাতে আমি হুযুর (সঃ) কে বিছানাতে পেলাম নাতাই তাঁকে খোজ করার উদ্দেশ্যে বের হলামতখন দেখতে পেলাম তিনি জান্নাতুন বাকীতে আছেনআমাকে দেখে তিনি বলে উঠেন, তুমি কি এই আশংকা করছো যে, আল্লাহ এবং তাঁর রসূল (সঃ) তোমার
সাথে অবিচার করবে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি ধারণা করেছিলাম আপনি অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে তাশরীফ নিয়েছেনহুযুর (সঃ) বললেন, শাবানের পনের তারিখ রাতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে তাশরীফ নেন এবং বনু কালব গোত্রের ভেড়া-বকরির পশমগুলোর চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে তিনি মাফ করে দেন
উক্ত হাদীসটিঃ
ইমাম তিরমিযী তাঁর তিরমিযী শরীফে
ইমাম ইবনে মাজাহ তাঁর সুনানে
ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
ইমাম ইবনে আবী শাইবাহ তাঁর মুসান্নাফে
ইমাম বগবী তাঁর শরহেস সুন্নাহয়
ইবনে আহমদ তাঁর মুসনাদে
সংকলন করেছেন

হাদীছটির সনদের অবস্থানঃ

প্রথম উক্তিঃ
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) হাদীছটির সনদ পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ
হযরত আয়শা (রঃ) এর হাদীছটি আমরা শুধুমাত্র হাজ্জাজ এর সূত্রে পাইআর আমি ইমাম বুখারী (রহঃ) কে বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদীছটিকে দুর্বল বলেছেনতিনি আরো বলেছেন যে, ইয়াহইয়া ইবনু আবি কাসীর উরওয়া থেকে হাদীছটি শ্রবণ করেননি আর হাজ্জাজও ইয়াহইয়া থেকে শ্রবণ করেননি
ইমাম তিরমিযীর এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, ইমাম বুখারী (রহঃ) হাদীছটিকে দুর্বল সাব্যস্ত করেছেনদুর্বল হওয়ার কারণ হচ্ছে যেহেতু হাদীসের সনদে দুই জায়গাতে ইনক্বিতা (রাবীর সাথে সাক্ষাত না হওয়া বা রেওয়ায়েত শ্রবণ না করা) পাওয়া গেছেআর তা এভাবে যে, প্রথমত হাজ্জাজ ইবনু আরতাত ইয়াহইয়া ইবনু আবি কাসীর থেকে হাদীছটি শুনেননিদ্বিতীয়ত, ইয়াহইয়া নিজে উরওয়াহ থেকে হাদীছটি শ্রবণ করেন নি

উক্ত উক্তির পর্যালোচনাঃ
ইমাম বুখারী (রহঃ) এর উক্ত মতামতের ব্যাপারে আমাদের সবিনয় বক্তব্য হলো, হাজ্জাজ যে ইয়াহইয়া থেকে শ্রবণ লাভ করেননি এই ব্যাপারে মুহাদ্দিছীনে কেরামের মাঝে কোন মতবিরোধ নেই, তবে ইয়াহইয়া যে উরওয়া থেকে শ্রবণ লাভ করেননি, এটা সর্বজনস্বীকৃত কথা নয়কারণ, ইবনু মঈন প্রমূখ প্রমাণ করেছেন যে, উরওয়া থেকে ইয়াহইয়া শ্রবণ লাভ করেছেন
যেমনঃ আল্লামা যুরকানী বলেনঃ
হাজ্জাজ ইয়াহইয়া থেকে শ্রবণ না করার বিষয়টি সর্বজনবিদিতকিন্তু ইয়াহইয়া উরওয়া থেকে শ্রবণ করার বিষয়টিও আবু যুরআহ ও আবু হাতিম প্রত্যাখান করেছেন আর ইবনু মঈন তা প্রমাণ করেছেনপ্রত্যাখানের চেয়ে প্রমাণই অগ্রগণ্য
(
মারিফুস সুনান, আল্লামা মুহাদ্দিস শায়খ ইউসুফ বিননুরীঃ খ-৫, পৃ-৪২০ )
(
আমরা যখন কোন কিছুর প্রমাণ পাই না, তখন তাকে ঠিক মনে করি না; কিন্তু এরপর যখন প্রমাণ পাই, তখন তা সঠিক বলে রায় দিইএখানেও একই ঘটনা ঘটেছে, আবু যুরআহ ও আবু হাতিম প্রমাণ পান নি বলে তা গ্রহণ করেন নি; কিন্তু ইবনু মঈন প্রমাণ পেয়েছেন তাই গ্রহণ করেছেনতাই যেহেতু আমাদের কাছে এখন প্রমাণ আছে, অতএব আমাদেরকে প্রমাণটিই গ্রহণ করতে হবে। )
অতএব উক্ত ব্যখ্যার আলোকে ইনক্বিতা কেবল এক জায়গাতে থাকেপরন্ত হানাফী মাযহাবের মুহাদ্দিছীনের মতে এ ধরণের ইনক্বিতা মূল হাদীছ প্রমাণ করার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে নাযেহেতু তার অন্য রাবীগণতো ছিক্বাহঅন্য হাদীছের মাধ্যমে তার সমর্থনও বিদ্যমানএই কারণেই ইবনু হিব্বান তার সহীহ নামক গ্রন্থে হযরত আয়শা (রঃ) এর এই হাদীছটি হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন
যেমনঃ শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাতে এসেছেঃ
শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে বহু হাদীছ এসেছেঅধিকাংশরা সেগুলোকে যঈফ বিবেচনা করছেনইবনু হিব্বান কয়েকটিকে সহীহ বলেছেনকিছু হাদীছকে উদারতা প্রদর্শন পূর্বক সহীহ বলেছেনআর কিছু হাদীছ হাসান হলেও সহীহ বলে দিয়েছেন এবং নিজ সহীহ নামক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেনকেননা উভয়টি দ্বারা (সহীহ ও হাসান) দলীল পেশ করা যায়হযরত আয়শা (রঃ) এর বর্ণিত উক্ত হাদীছটিও এ ধরনেরই
(
শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাতঃ খ-৭, পৃ-৪৪১ )

এমনকি হযরত আয়শা (রঃ) এর এই হাদীছটি ইমাম তিরমিযী ছাড়াও
ক) ইমাম ইবনু মাযাহ তাঁর সুনান-এ
খ) ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ তাঁর মুসান্নফ-এ
গ) ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদ এ
ঘ) ইমাম বায়হাকী শুআবুল ঈমান ও ফাযাইলে আওক্বাত অধ্যায়-এ
এবং
ঙ) ইমাম বগভী তাঁর শরহুস সুন্নাহ এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন
কিন্তু এসব বড় বড় মুহাদ্দিছের মধ্য থেকে কেউই হাদীছটি জাল বলেন নি কিংবা অত্যাধিক দুর্বলও বলেননি বরং হাদীছটির সনদের সমস্ত রাবী ছিক্বাহ এবং অন্য আরো হাদীছের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় হাদীছটি শক্তিশালী হয়ে যায়সুতরাং নিঃসন্দেহে হাদীছটি হাসান এবং সহীহ লিগাইরিহী এর স্তরের

দ্বিতীয় উক্তিঃ
মুসনাদে আহমদের মুহাক্কিক বিশিষ্ট হাদীছ পর্যালোচক হামযা আহমদ আয যায়্যান উক্ত হাদীছ সম্পর্কে পরিষ্কার মন্তব্য করেছেন اسناده حسن হাদীছের সূত্র হাসানের স্তরের
(
দেখুনঃ মুসনাদে আহমদের টীকা )

তৃতীয় উক্তিঃ
ইমাম বায়হাকী (রহঃ) উক্ত হাদীছটি সংকলন করার পর বলেনঃ
এ হাদীছের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে হযরত আয়শা, আবু বকর সিদ্দীক এবং হযরত আবু মূসা আশআরী কর্তৃক বর্ণিত হাদীছসমূহসুতরাং আলোচ্য হাদীছটি এসকল হাদীছের সমর্থনে সহীহ বলে সাব্যস্ততাই শায়খ হামজা আহমদ আযযায়্যান হাদীছটিকে اسناده حسن বলে মন্তব্য করেছেন

সার কথাঃ
হযরত আয়শা (রঃ) এর উপরোক্ত হাদীসটিতে এক জায়গায় ইনতিক্বা পাওয়া যায় আর অনেক বড় বড় ইমাম ও মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে বিশেষ করে হানাফী মাযহাবের মুহাদ্দিসীনের কাছে এ ধরণের ইনতিক্বা মূল হাদীস প্রমাণের ক্ষেত্রে অন্তরায় নয় যদি হাদীসের অন্য রাবীগণ ছিক্বাহ হন
শায়খ আলবানী (রহঃ) নিজেও এই হাদীসের সমস্ত রাবীকে বিশ্বস্ত বলেছেন
(
সিলসিলাতুস আহাদিসা সহীহা )

অতএব, হাদীসটি হাসান পর্যায়ের অন্তর্ভুক্তইমাম সুয়ূতী তদীয় জামিউস সগীরগ্রন্থে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন
দ্বিতীয়ত, এ হাদীসের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং এর সমর্থনে অনেক হাদীস পাওয়া যায় যেমনঃ আবু বকর ছিদ্দীক (রঃ) এর সহীহ হাদীছ, হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রঃ) এর সহীহ হাদীস, হযরত আবু মুসা আশআরী (রঃ) এর হাসান হাদীছএমনকি খোদ হযরত আয়েশা (রঃ) থেকেই বিভিন্ন সূত্রে হাদীছের বিভিন্ন কিতাবেই এই হাদীছটি বর্ণিত আছেতাই সবকিছু একত্রে করে এ কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, হাদীসটি হাসান পর্যায়ের
ইমাম বায়হাকী
আল্লামা যুরকানী
ইমাম সুয়ুতী
ইমাম ইবনু হিব্বান
শায়খ হামযা আহমদ আয যায়্যান
প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হাদীছটির হাসান হওয়াতে সত্যায়ন করেছেন
তৃতীয়ত, এরপরও যদি কেউ হাদীসটিকে দুর্বল আখ্যায়িত করতে চান, তবুও এই হাদীছটি গ্রহণ করা যাবেকারণ ফাজায়েলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীছ গ্রহণ করা যায়, এতে ইমামগণের ইজমা আছেউসূলে হাদীছের নীতিমালা সম্পর্কে জানতে চাইলে আমার দেওয়া ৮ম পর্বটি দেখে আসুন



পঞ্চম হাদীছ( حسن)
হযরত আবু মূসা আল আশআরী (রঃ) রসূলুল্লাহ (সঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেনঃ অবশ্যই আল্লাহ তাআলা শাবান মাসের পনের তারিখ রাতের বেলায় (সৃষ্টিজীবের) প্রতি মনোযোগ প্রদান করেনতারপর মুশরিক এবং হিংসুক ব্যতীত সকল মাখলুককে মাগফিরাত ফরমান

উক্ত হাদীসটিঃ
ইমাম ইবনে মাজাহ তাঁর সুনানে
ইমাম বায়হাকী তাঁর ফাযায়িলুল আওক্বাতে
ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
বাযযার তাঁর মুসনাদে
ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদে
ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে
ইবনে হিব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে
ইমাম তাবরানী তাঁর কাবীরে
সংকলন করেছেন

উক্ত হাদীছের সনদ সম্পর্কে পর্যালোচনাঃ
উক্ত হাদীছ ইমাম ইবনু মাজাহ রাশিদ ইবনু সাঈদ ইবনু রাশিদ আররামালী থেকে বর্ণনা করেছেন
যাঁর সম্পর্কে হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেনঃ
দশম স্তরের একজন সত্যবাদী রাবী
(
তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৩, পৃ-১৯৬ )
ওলীদ ইবনু মুসলিম আল কারশী
যাঁর সম্পর্কে ইবনু হাজার বলেনঃ
তিনি একজন ছিক্বাহ রাবীমুদাল্লাস রেওয়ায়েত অধিক করেছেন
(
তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-২, পৃ-২৮৯; খ-১১, পৃ-১৩৪ )
ইবনু সাআদ তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ
ওলীদ একজন নির্ভরযোগ্য অধিক হাদীছ বর্ণনাকারী ছিলেন
(
তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-১১, পৃ-১৩৪ )

ابن لهيعة ইবনু লাহীআহ
যার সম্পর্কে হাফিয হাইসামী এর বরাতে পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর হাদীছ হাসান

ضحاك بن الايمن যাহহাক ইবনু আইমান
হাফিয ইবনু হাজার এবং হাফেজ জাহাবী বলেন তিনি মাজহুল অর্থা অজ্ঞাত
(
তাহযীবুত তাহযীব; মীযানুল ইতিদাল )

যাহহাক ইবনু আবদির রাহমান আরযাব
হাফিয ইবনু হাজার, হাফিয আজালী বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য তাবেয়ী। ( তাহজীবুত তাহজীব )
আবু মূসা আল আশআরী (রঃ) তিনি একজন জলীলুল ক্বদর সাহাবী

হাদীছটির অবস্থানঃ
উল্লেখিত পর্যালোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এই হাদীছের সনদে শুধু মাত্র একজন রাবী অর্থা জাহহাক ইবনু আইমান মাজহূল তথা অপরিচিতএছাড়া অবশিষ্ট সকল রাবী নির্ভরযোগ্যআর ইবনু লাহীআর হাদীছ হাসান স্তরের। (এ ক্ষেত্রে) শুধুমাত্র একজন রাবী এর পরিচয় জানা না থাকলে মূল হাদীছ প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনরূপ অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে নাকারণ এই হাদীছের অনুকূলে ও সমর্থনে আরও হাদীছ তো অবশ্যই পাওয়া যায়আর আমরা শুরুতে একথা বলে আসছিলাম যে, যঈফ রেওয়ায়েত যদি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়, তাহলে হাসানস্তরে উন্নীত হয়
এ জন্যই সমকালীন হাদীছ পর্যালোচক আল্লামা নাসির উদ্দীন আলবানী আবু মূসা আশআরী (রঃ) এর হাদীছকে صحيح سنن ابن ماجه গ্রন্থে হাসান হিসেবে প্রমাণিত করেছেন
(
দেখুনঃ সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ, আলবানীঃ খ- ১, পৃ- ২৩৩ )

সার কথাঃ
হযরত আবু মূসা আশআরী (রঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটিতে একজন অজ্ঞাত রাবী আছেন কিন্তু যেহেতু এই হাদীছের সমর্থনে হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রঃ), হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রঃ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রঃ) এর শক্তিশালী সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে, তাই উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী হাদীসটি দুর্বল হবে না, হাসান হয়ে যাবে
এজন্যই আহলে হাদীছ বা সালাফীদের অন্যতম গণ্যমান্য ব্যক্তি আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন এবং তাঁর সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহতে উল্লেখ করে প্রমাণও করেছেন

ষষ্ঠ হাদীস( حديث ضعيف صحيح بشواهده)
হযরত আবু ছালাবাহ আল খুশানী (রঃ) থেকে বর্ণিত রসূল (সঃ) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে স্বীয় বান্দাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেনঅতঃপর মুমিনগণকে ক্ষমা করেন, কাফিরদেরকে সুযোগ দেনআর বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে তাদের বিদ্বেষ পরিত্যাগ করা পর্যন্ত অবকাশ দেন

উক্ত হাদীসটিঃ
ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
ইমাম তাবরানী তাঁর কাবীরে
ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে
সংকলন করেছেন

উক্ত হাদীছের সনদ পর্যালোচনাঃ
প্রথম উক্তিঃ
হাফিয যকী উদ্দীন আল মুনযিরী হাদীছটিকে বর্ণনা করার পর বলেনঃ
ইমাম বায়হাকী (রহঃ) বলেছেনঃ এই হাদীছের সনদে মাকহূল এবং আবু ছালাবাহ এর মাঝখানে ইরসাল (রাবী এর বিলুপ্তি) রয়েছে
আর আমরা ভূমিকাতে (উসূলে হাদীসের নীতিমালায়, ৮ম পর্ব) উল্লেখ করেছিলাম যে, হানাফী ও মালেকী মুহাদ্দিছদের মতে মুরসাল হাদীছ সহীহ এবং প্রমাণ পেশ করার যোগ্য
এ হাদীছের সূত্রে একজন রাবী রয়েছেন, আল আহওয়াজ ইবনু হাকীম

দ্বিতীয় উক্তিঃ
তাঁর ব্যাপারে হাফেজ হায়ছামী মন্তব্য করেন এভাবেঃ
হাফিয হাইছামী বলেনঃ উক্ত হাদীছ তাবরানী বর্ণনা করেছেনতার সনদে আহওয়াস ইবনু হাকীম নামক একজন রাবী আছেনতিনি দুর্বল
(
মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )

তৃতীয় উক্তিঃ
অন্য দিকে তার ব্যাপারে শায়খে বুখারী আলী ইবনু মাদীনী বলেনঃ والاحوص ثقة আহওয়াস নির্ভরযোগ্য
(
তাহযীবুল কামাল )

হাফিয হাইছামী এর বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, এই হাদীছের সনদে একজন দুর্বল রাবী আছে, তিনি ছাড়া অন্যান্য রাবীগণ ছিক্বাহএই দৃষ্টিকোণে যদিও হাদীছটি দুর্বলকিন্তু তার সমর্থনে হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রঃ), হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রঃ), হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রঃ) এর সহীহ হাদীছসহ আরো হাদীছ থাকায় উসূলে হাদীছের নীতিমালা অনুযায়ী হাদীছটি আর দুর্বল থাকে না

আহলে হাদীস/সালাফী ভাইদের কাছে প্রশ্ন ও দাওয়াতঃ
প্রথমত, উপরে বর্ণিত তিনটি হাদীসের প্রথমটির সনদ হাসান পর্যায়ের, আর বাকী দুইটি কিছুটা দুর্বল
দ্বিতীয়ত, হাদীস গুলোর সমর্থনে আরও অনেক হাদীস থাকায় উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী এই হাদীস গুলো হাসান বা সহীহের পর্যায়ে চলে আসে
তৃতীয়ত, হাদীসগুলো কিছুটা দুর্বল হলেও ফাজায়েলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীছ গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্যএটি উসূলে হাদীসের অন্যতম একটি নীতিমালা
অনেক বড় বড় মুহাদ্দিসরাই এই হাদীস গুলোর তাহকীক করেছেন এবং এগুলোকে সামষ্টিকভাবে হাসান বলে রায় দিয়েছেন
অন্যদিকে হাদীসের তাহকিক তথা বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সালাফী/আহলে হাদীছ ভাইরা যার সবচেয়ে বেশি ভক্ত, যার কিতবাদি অনুবাদ করে আপনারা প্রচার করে থাকেন, সময়কালের বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ নাসিরউদ্দীন আলবানীও (রহঃ) উপরে বর্ণিত শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ক হাদীসগুলোর একটিকে হাসান বলেছেন
তাই আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তাহলে কেন আপনারা বার বার বলেন যে, শবে বরাতের ফযীলত নিয়ে কোন সহীহ হাদীস বা হাসান হাদীসও বর্ণিত নেই ??
এখন সালাফী বা আহলের হাদীসের ঐসব বন্ধুদের প্রতি দাওয়াত রইল, আপনারা আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ), শায়খ আলবানী (রহঃ) এর গবেষণা ও সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনআমি ওই সব ভাইদের কাছে বিনীতভাবে আরজ করতে চাই যে, আপনারা যদি শায়খ ইবনে বাযের (রহঃ) অনুসরণে বা নিজেদের তাহ্কীক মতো এই রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করতে পারেন তাহলে যারা উপরোক্ত মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের অনুসরণে উল্লেখিত হাদীসটির ভিত্তিতে এই রাতের ফযীলতের বিশ্বাস পোষণ করেন এবং সব ধরণের বেদআত রসম-রেওয়াজ পরিহার করে নেক আমলে মগ্ন থাকার চেষ্টা করেন তারাই এমন কি অপরাধ করে বসলেন যে, আপনাদেরকে তাদের পেছনে লেগে থাকতে হবে? এবং এখানকার উলামায়ে কেরামের দলীলভিত্তিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে অন্য একটি মত যা ভুলের সম্ভাবনার উর্ধ্বে নয়, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে তাদেরকে আলেম-উলামার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আস্থাহীন করা এবং বাতিলপন্থিদের মিশন সফল করতে সহায়তা দেওয়া কি সত্যিকার অর্থেই খুব বেশি প্রয়োজন? এতে তো কোন সন্দেহ নেই যে, আপনারা আপনাদের মতটিকে খুব বেশি হলে একটি ইজতেহাদী ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনাযুক্তই মনে করেন এবং নিশ্চয়ই আপনারা আপনাদের মতটিকে একেবারে ওহীর মতো মনে করেন নাএকটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন, এরপর আপনাদের এই অবস্থানের যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা আর থাকে কি না?
আপনাদের প্রতি আমার সর্বশেষ অনুরোধ এই যে, দয়া করে এ রাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) [মৃ. ৭২৮ হিঃ] এর ইক্তিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম/৬৩১-৬৪১ এবং ইমাম যায়নুদ্দীন ইবনে রজব (রহঃ) [মৃ. ৭৯৫] এর লাতায়েফুল মাআরেফ ১৫১-১৫৭ পড়ুন এবং ভেবে দেখুন যে, তাদের এই দলীলনির্ভর তাহকীক অনুসরণযোগ্য, না শায়খ ইবনে বায (রহঃ) এর একটি আবেগপ্রসূত মতামত? যা হয়ত তিনি শবে বরাত নিয়ে জাহেল লোকদের বাড়াবাড়ির প্রতিকার হিসেবেই ব্যক্ত করেছেনকিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে, বাড়াবাড়ির প্রতিকার কোন বাস্তব সত্য অস্বীকার করে নয়; বরং সত্য বিষয়টির যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে

শেষ কথাঃ
যদি অন্যান্য রাতের উপর এ রাতের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নাই থাকবে, তবে বিশেষভাবে এই রাতের কথা উল্লেখ করারই বা কি প্রয়োজন ? শুধু এই রাতকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মাধ্যমেই অন্যান্য রাতের উপর এর বিশেষত্ব প্রমাণিত হয়
উপরের হাদীসগুলো থেকে স্পষ্টতই এটা প্রমাণিত হয় যে, এ রাত্রে আল্লাহ পাক তাঁর বিপুল সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করেনযে রাত্রে আল্লাহ বিশেষভাবে ক্ষমার ওয়াদা করেছেন, সেই রাতে কাকুতি মিনতি করে তাঁর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে এটাই স্বাভাবিকআর আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া, তওবা করা বা যে কোন দোয়া করার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল কোন ভাল আমলের মাধ্যমে দোয়াটিকে শক্ত করা যাতে দ্রুত কবুল হয়বুখারী শরীফের তিন জন যুবকের কাহিনী হতে বিষয়টি স্পষ্ট হয় যারা পাহাড়ের গুহাতে আটকা পড়ে গিয়েছিলপরে একজনের পরামর্শে প্রত্যেকের ভাল আমল উল্লেখ করে দোয়া করলে আল্লাহ তাদের মুক্ত করেনতাছাড়া অনেক হাদীসেই নফল নামায পড়ে দোয়া করা, কোরআন তিলাওয়াত করে দোয়া করা, জিকির আযকার করে দোয়া করা ইত্যাদির প্রতি বিশেষভাবে উসাহিত করা হয়েছেসুতরাং মধ্য শাবানের এই রাতে আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষভাবে ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে সালাত, যিকির, কোরআন তিলাওয়াত করাও প্রমাণিত হয় এরপরও যদি কেউ বলে থাকেন যে, এই রাতে কোন ইবাদত করা যাবে না, তাহলে তা তার নিজের মনগড়া কথা বা প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়