মঙ্গলবার, ২৬ জুন, ২০১২

কুরআন-হাদীছের আলোকে শবে বরাত - পর্ব ০৩


بسم الله الرحمن الرحيم

লাইলাতুল বারাআত পরিচিতি

বার মাস সম্বলিত আরবী বছরের ৮ম মাস হচ্ছে মাহে শাবানযা রমজানের পূর্ববর্তী সময়ে অবস্থিতএ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ফার্সী ভাষায় শবে বরাত বলা হয়ফার্সীতে শব অর্থ রাত/রজনী; বরাত অর্থা ভাগ্যশবে বরাত অর্থা ভাগ্যরজনীআরবী ভাষায়ও বরাত শব্দ ব্যবহৃত হয়তবে তখন উচ্চারণ হবে বারাআতআর শব শব্দের আরবী অনুবাদ (প্রতিশব্দ) হলো লাইলাতুন কাজেই ভাষারীতির আলোকে বলতে হবে ليلة البراءةলাইলাতুল বারাআত বা পরিত্রাণের রজনী

এ রাতকে কুরআনের ভাষায় (মুফাসসিরীনের একটি দলের মতানুসারে) লাইলাতুল মুবারাকাহ ” ( ليلة مباركة ) বরকতময় রাত এবং হাদীছের ভাষায় লাইলাতুন নিসফি মিন
শাবান ” ( ليلة النصف من شعبان ) অর্থা শাবান মাসের মধ্যরাত্রি বলা হয়

তাফসীর গ্রন্থে এর আরো নাম পাওয়া যায়যেমনঃ

ক) ( ليلة الرحمة ) লাইলাতুর রাহমাহ অর্থা রহমত অবতীর্ণ হওয়ার রজনী
খ) ( ليلة الصك ) লাইলাতুসসাক অর্থা দলীল দস্তাবেজের রজনী
গ) ( ليلة البراءة ) লাইলাতুল বারাআত তথা জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের রজনী

মূলতঃ যে বিষয়ে এখানে আলোচনা করতে যাচ্ছি তা

ক) বহুসংখ্যক সলফে-সালেহীনের অনেকের অঙ্কিত নাম অনুসারে শবে বরাত
খ) কুরআনের ভাষ্য মতে লাইলাতুম মুবারাকাহ
গ) মুফাসসিরীনদের ভাষ্য মতে লাইলাতুল বারাআত
ঘ) হাদীসের ভাষ্য মতে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান ” (মধ্য শাবানের রাত্র)
হিসেবে সুপরিচিত

যেহেতু মধ্য এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশ এলাকায় এক সময় ফার্সী ভাষার সর্বাধিক প্রচলন ছিল বিধায় এ পবিত্র রজনীটি ফার্সী ভাষা অনুযায়ী শবে বরাত নামে সাধারণ মুসলমানদের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেএ জন্য আমরা এটাকে সাধারণতঃ শবে বরাত বলে থাকিকাজেই এখানে একটি বিষয় অতি পরিষ্কার যে, “ শবে বরাত আরবী নয় বরং ফার্সী শব্দএ জন্য শব্দটি কুরআন ও হাদীছ উভয়ের মাঝে উল্লেখ থাকার প্রশ্নই আসে নাযেমনঃ নামায, রোজা, দরূদ এর ব্যবহার কুরআন হাদীছে ব্যবহৃত হয়নিবরং তদস্থলে সালাত, সিয়াম ইত্যাদি আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সুতরাং কেউ যদি শবে বরাত শব্দটি কুরআনে হাদীছে নেই বলে এটা অমান্য করতে চায় বা বিদআত বলতে চায় তাহলে নামায, রোজা, দরূদ শরীফকেও তাদের বিদআত বলতে হবে কেননা এসব শব্দ ফার্সী হওয়ায় কুরআন-সুন্নাহ কোথাও ব্যবহৃত হয়নি

অতএব নির্দ্বিধায় বলতে হবে, মধ্য এশিয়ার ওলামাদের পরিভাষায় এটা শবে বরাত হলেও তার আসল নাম

ক) কুরআনের পরিভাষায় ليلة مباركةলাইলাতুম মুবারাকাহ ” (পবিত্র রাত)
খ) হাদীছের পরিভাষায় ليلة النصف من شعبانলায়লাতুন নিসফি মিন শাবান ” (মধ্য শাবানের রাত্রি)
গ) তাফসীরের ভাষায় ليلة الصكলাইলাতুসসাক ليلة الرحمةলাইলাতুর রাহমাহ ليلة البراءةলাইলাতুল বারাআত

কেই বুঝানো হয়েছেযার কারণসহ বিস্তারিত বিবরণ পরে উল্লেখ করা হবে; ইনশাআল্লাহ

আল্লাহ পাক মানবজাতিকে সৃষ্টিকুলের উপর মহাসম্মানে ভূষিত করে বলেছেনঃ

অর্থা আমি নিঃসন্দেহে আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি এবং মানব জাতির মধ্যে সকল উম্মতের উপর উম্মতে মুহাম্মদীর ঈমানদার সম্প্রদায়কে অগণিত নিয়ামত ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে ধন্য করেছি

সুরা আর রহমানে বহু নিয়ামত প্রদানের কথা উল্লেখ করে বার বার বলেছেনঃ

فبأى آلاء ربكما تكذبان

তোমরা কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে

এসব নিয়ামতের মধ্যে অন্যতম নেয়ামত হচ্ছে বিশেষ বিশেষ দিন ও রাতকে মর্যাদা প্রদান করাএমনিতে ইসলামের তাওহীদী আক্বীদার দৃষ্টিতে দিন ও রাতের প্রত্যেক মুহূর্তই বরকত ও মর্যাদা প্রাপ্তকোন দিন ও রাত ও মুহূর্তকে অকল্যাণকর বলে ধারণা রাখা শরীয়ত পরিপন্থী

কারণ হাদীছে কুদসীতে হুজুর (সঃ) ইরশাদ করেনঃ

যুগ ও সময় আসলে আমি আল্লাহর শানের নাম তাই তাকে গালমন্দ, অভিশাপ দিও না যুগ-কালের মধ্যে যা কিছু ঘটানো হয় তা আমিই ঘটাইযুগকে গালমন্দ করার অর্থ হবে আমাকেই গালমন্দ করাতাই তোমরা তা কখনো করো না

তবে আল্লাহ তাআলা বরকত ও মর্যাদার দিক দিয়ে কোন কোন মাসকে অন্য মাসের তুলনায়, কোন কোন দিন ও রাতকে অন্য দিন বা রাত্র হতে অধিক মর্যাদাপূর্ণ করেছেনযেমন পূণ্যবান রজনীগুলোর মধ্যে শবে ক্বদর, ঈদের রাত্রদ্বয়, জুমার রাত, শবে মেরাজ, শবে বরাতকে অন্যান্য রাত থেকে অধিক বরকতপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেনতেমনিভাবে দিনের মধ্য থেকে আরাফার দিন, দুই ঈদের দিন, জুমআর দিন ইত্যাদিকে অন্যান্য দিন হতে অধিক প্রাধান্য ও মর্যাদাপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন

১০ বলাবাহুল্য, আল্লাহ তাআলা শাবান মাস ও তার পনের তারিখের রজনীকে উম্মতে মুহাম্মদিয়ার জন্য রহমত ও বরকত স্বরূপ ও গুনাহ মার্জনার মৌসুম বলে অভিহিত করেছেনশবে বরাতও এরই ছোঁয়ায় সমৃদ্ধউল্লেখ্য যে, আল্লাহ তাআলা পুরো বছরই শেষ রাতে বান্দার গুনাহ মার্জনা করে থাকেন বলে হাদীছে-নুযূলে উল্লেখ রয়েছেকিন্তু শবে বরাত সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, তিনি সূর্যাস্ত থেকে সকাল পর্যন্ত পুরো রাতই বিশেষ রহমত ও ক্ষমার আহবান করতে থাকেনযেমনটি করেন শবে ক্বদরেতাফসীর গ্রন্থে বিশেষ দিন-রাত্রের মর্যাদার কারণ হিসেবে পাওয়া যায় যে, অন্যান্য নবী-রাসূল এর উম্মতগণ হাজার-বারশত বছরের হায়াত পেয়ে দীর্ঘকাল ইবাদত করে জান্নাতের অধিকারী হওয়ার সুযোগ পেতোকিন্তু উম্মতে মুহাম্মদিয়া সাধারণত হায়াত পেয়ে থাকে ৬০ থেকে ৭০ বছর, অথচ এরা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মতসুতরাং এ স্বল্প সময়ের ইবাদতকে এরা যেন দীর্ঘ সময়ের ইবাদতের চেয়েও অধিক পূণ্যবান করে সত্যিকার অর্থে শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারেন এ লক্ষ্যে মহান আল্লাহ বিশেষ কিছু সময়, মাস, দিন রাতকে বরকতপূর্ণ করে এমন মর্যাদাশীল করেছেন যাতে এ বিশেষ সময়গুলোতে এ উম্মত তওবার মাধ্যমে আপন গুনাহসমূহ হতে মুক্তি পেতে সক্ষম হয় এবং হাজার হাজার বছর ইবাদত করে জান্নাত অর্জনকারী অন্যান্য উম্মতের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সুযোগ পায়

(
দেখুন তাফসীরে সূরা ক্বদর )

শবে বরাতের কয়েকটি নাম ও নামকরণের কারণ

লাইলাতুম মুবারাকাহ তথা বরকতপূর্ণ রজনীঃ

কুরআনের ভাষায় একদল মুফসসিরীনের মতানুযায়ী-এটির নাম লাইলাতুম মুবারাকাহ ( ليلة مباركة ) তথা বরকতপূর্ণ রজনীএ রাতটিকে মোবারাকাহ বলার কয়েকটি কারণ রয়েছে

ক) এ রাতে কুরআনুল কারীম লৌহে মাহফুজ থেকে এ দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ করা হয় অথবা এ রাত্রে কুরআনুল কারীমের অবতরণের ফায়সালা বা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ঠিক সে বছর রমজান মাসের শবে ক্বদরেই পবিত্র কুরআন নাযিল শুরু হয় দৃষ্টিকোণে রাতটি বরকতপূর্ণ ও মহাপবিত্র রজনীতাই একে লাইলাতুম মুবারাকাহ ” (বরকতপূর্ণ রজনী) বলে নামকরণ করা হয়েছে

খ) এ রাতের প্রারম্ভেই অগণিত ফেরেশতা রহমত ও বরকত নিয়ে অবতীর্ণ হয় এবং রাতব্যাপী জমিনে বিচরণ করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ বান্দাদের উপর রহমত বর্ষণ করতে থাকেযেমনটি হাদীছে বর্ণিত রয়েছেতাই রাতটিকে বরকতপূর্ণ রাত বলা হয়

গ) এ রজনীতে আল্লাহ তাআলা যমযমের পানির মধ্যে বিশেষ বরকত নাযিল করেন এমনকি বাহ্যিকভাবেও যমযমের পানি বৃদ্ধির মাধ্যমে সে বরকত পরিলক্ষিত হয়যার বর্ণনা তাফসীর গ্রন্থে বিদ্যমানযেমনঃ

قيل يزيد فى هذه الليلة ماء ز مز م زيادة ظاهرة

(
হাশিয়াতুত তাফসীরে কাবীরঃ খ-৭, পৃ-৬৯৩ )

লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান তথা শাবানের পঞ্চদশ রজনীঃ

হাদীছের ভাষায় লাইলাতুল বারাআত এর একটি প্রসিদ্ধ নাম হচ্ছে ليلة النصف من شعبان লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান। (এ নামটি ছাড়াও আরো বিভিন্ন নাম হাদীছ গ্রন্থে পাওয়া যায়) যার অর্থ হলো মধ্য শাবানের রাত্রি বা ১৫ই শাবানের রাত কারণ শবে বরাত সংশ্লিষ্ট সকল-বরকত ফযীলত ও বৈশিষ্ট্যাবলী এ রাতেই অবস্থিত তাই হাদীছ শরীফে মধ্য-শাবানের রাত, তথা ১৫ই শাবানের রাত দ্বারা সর্বজন পরিচিত শবে বরাতকেই বুঝানো হয়েছে

লাইলাতুল বরাআতঃ

লাইলাতুল বারাআত ليلة البراءة বারাআত শব্দের অর্থ মুক্তি লাভহাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী এ রাত্রিতে যেহেতু আল্লাহ তাআলা নেক বান্দাদের এক বৃহ দলের গুনাহ মাফ করে দিয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান করে দেনতাই এ রাতটিকে লাইলাতুল বারাআত বলে নামকরণ করা হয়েছেএর প্রমাণ স্বরূপ দুটি কিতাবের উদ্ধৃতি প্রদান করা হলোঃ

ক) ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহঃ) বলেনঃ

এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত করে এ জন্যই নামকরণ করা হয়েছে যে, টেক্স আদায়কারীগণ জনগণ থেকে পূর্ণ কর আদায় করে তাদেরকে বারাআত অর্থা দায়মুক্ত বলে একটি দলীল হস্তান্তর করতেন, তদ্রূপ আল্লাহ তাআলাও মুমিন বান্দাদেরকে - এ রাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তির কথা লিখে দেন

(
দেখুন তাফসীরে কবীরঃ খ ১৪, পৃ ২৩৯ )

খ) তাফসীরে রূহুল বয়ানে ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) সম্পর্কে একটি চমকার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, প্রমাণস্বরূপ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে

হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) মধ্য শাবানের রাতে যখন নামাযের সিজদাহ থেকে মাথা উঠান তখন সবুজ রং এর একটি কাগজের টুকরা পেলেন যার নূরের আলো আসমান পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছেতাতে লিখা ছিল আল্লাহ পাক তার প্রিয় বান্দা ওমর বিন আব্দুল আযীযকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত বলে ঘোষণা দিলেন” ”

(
দেখুন রূহুল বয়ানঃ খ , পৃ ৪০৪ )

লাইলাতুস্‌সাক তথা সনদের রজনীঃ

শবে বরাতের আরেকটি নাম হাদীছে এসেছে ( ليلة الصك ) লাইলাতুসসাক আভিধানিক অর্থ হলো এক্বরার নামা বা স্বীকারমূলক দলীল দস্তাবেজএ নামে নামকরণের কারণ হলো এ পবিত্র রজনীতে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়ার প্রমাণ স্বরূপ জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদ-দলীল জারি করেন

লাইলাতুর রহমাহ তথা রহমতের রাতঃ

আরেকটি নাম রয়েছে ( ليلة الرحمة ) লাইলাতুর রহমাহ তথা রহমতের রাত শবেবরাতকে রহমতের রাত হিসেবে এ জন্য নামকরণ করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) হাদীছ শরীফে উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের উপর এ রাতে বনুকাল্‌ব গোত্রের ছাগলের পশম পরিমাণে রহমত নাযিল করেনঅর্থা অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা ও মার্জনা করেন

(
তাফসীরে কাবীরঃ খ-৭, পৃ-৪৪৫ )

শবে বরাতকে এ সব নামে নামকরণ প্রসঙ্গে প্রমাণ স্বরূপ তাফসীরগ্রন্থসমূহ থেকে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহঃ) এর তাফসীর কাবীরের বর্ণনা নিম্নে পেশ করা হচ্ছেতিনি বলেনঃ

মধ্য-শাবানের রাতের আরো চারটি নাম রয়েছে যথাঃ লাইলাতুম মুবারাকাহ, লাইলাতুল বারাআত, লাইলাতুসসাক ও লাইলাতুর রহমাহ ইত্যাদি

(
দেখুন তাফসীরে কবীরঃ খ ১৪, পৃ ২৩৯ )

শেষ কথাঃ

এখানে একটি বিষয় জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে, অধিকাংশ মুফাসসিরে কেরামের মতে সূরা দুখানের " লাইলাতুম মুবারাকাহ " এর অর্থ শবে ক্বদর, শবে বরাত নয়তবে একদল মুফাসসিরে কেরাম এর অর্থ শবে বরাত করেছেনতাই তাফসীরগ্রন্থ সমূহে দেখা যায়, যে সব মুফাসসিরে কেরাম এর অর্থ হিসেবে শবে ক্বদরকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই আবার এটা স্বীকার করেছেন যে, অনেক মুফাসসিরে কেরাম এর অর্থ শবে বরাতও করেছেন এবং তাই তারা তাদের নিজ নিজ তাফসীর গ্রন্থে এর উল্লেখও করেছেনযেমন, উপরে তাফসীরে কাবীরের দলীল দেখানো হয়েছে