বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

কুরআন-হাদীছের আলোকে শবে বরাত - পর্ব ১৫


بسم الله الرحمن الرحيم
হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ৭
গত কয়েক পর্বে আমরা শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত মোট আটটি হাদীস উল্লেখ করে সেগুলোকে সহীহ বা হাসান প্রমাণ করেছিলামযদি শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে আর কোন হাদীস না থাকত, তবে এই হাদীসগুলোই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত
এই পর্বে আমরা আরও একটি হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করব এবং সাথে সাথে এই হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের মতামত পর্যালোচনা করব

নবম হাদীছ( حديث صحيح بشواهده واسناده مر سل جيد )
কাসীর ইবনু মুররাহ আল হাযরামী থেকে বর্ণিত, হুযুর (সঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা শাবানের পনের তারিখ রাত্রি অবতরণ করতঃ মুশরিক এবং হিংসাপরায়ণ লোক ছাড়া অন্যান্য সকলের
গুনাহ মাফ করে দেন
উক্ত হাদীছটি
ইবনে আবী শাইবা তাঁর মুসান্নাফে
হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক তাঁর মুসান্নাফে
ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
হাফেয মুনযিরী তাঁর তারগীব ওয়াত তারহীবে
সংকলন করেছেন

হাদীছটির সূত্রের অবস্থানঃ
শুয়াবুল ঈমানে বর্ণিত সূত্রে রাবীগণের ব্যাপারে হাদীছ পর্যালোচকদের মন্তব্য নিম্নরূপঃ
রাবী আবুল হাসান বিন ফযল আলকাত্তান
তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য হলঃ
খতীব বাগদাদী ইবনুল ইমাদ আল হাম্বলী এবং হাফিয যাহাবীসহ অনেকেই তাকে নির্ভরযোগ্য ও বহু হাদীছের বর্ণনাকারী হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন
(
তারীখে বাগদাদ )

আবু সাহাল বিন যায়াদ আল কাত্তান
তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য হলোঃ
হাফেয যাহাবী এবং খতীব বাগদাদী তাঁর ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী বলে মন্তব্য করেছেন
(
তারীখে বাগদাদ; সিয়ারু আলামিন নুবালা )

ইসহাক ইবনে হাসান আল হারবী
তাঁর সম্পর্কে হাফেয যাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ বিন হাম্বল এবং ইবনু হাজার আসকালানী সকলেই বলেছেনঃ
ثقة حجة
অর্থা নির্ভরযোগ্য ও দলীলরূপে সাব্যস্ত
(
দেখুনঃ মীযানুল ইতেদালঃ ১/১৯০ )

আফফান বিন মুসলিম আল বাসারী
তাঁর সম্পর্কে ইবনে মুঈন আবু হাতিম এবং ইবনু হাজার মন্তব্য করেনঃ
اصحاب الحديث ثقة ثبت متقن
অর্থা বড় মাপের মুহাদ্দিছ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, অতি মজবুত

আব্দুল ওয়াহিদ বিন যিয়াদ
তাঁর সম্পর্কে ইবনে সাআদ আবু হাতিম, আবু যুরআ এবং ইবনে হাজার বলেনঃ
ثقة অর্থা নির্ভরযোগ্য

হাজ্জাজ বিন আরত্বাত্ব
তাঁর সম্পর্কে আবু যুরআ বলেনঃ
صدوق يدلس অর্থা সত্যবাদী তবে তাদলীস করেন
আবু হাতিম বলেনঃ
صدوق يدلس عن الضعفاء يكتب حديثه অর্থা সত্যবাদী, তাদলীস করেন তবে তাঁর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য ( তাহযীবুল কামাল )
ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন বলেন, হাজ্জাজ ইবনে আরত্বাত্ব ইমাম মাকহূল থেকে হাদীছ শুনেছেনবহুক্ষেত্রে তা স্পষ্টভাবে سمعت مكحولا বলে উল্লেখ করেছেন ( দেখুনঃ তারীখে বাগদাদ )
ইমাম নাসাঈ মন্তব্য করেছেনঃ তিনি তেমন মজবুত নন
ইবনে হাজার বলেনঃ সত্যবাদী তবে অনেক বেশি ভুল করেছেন
সময়কালের হাদীছ পর্যালোচক শায়খ আল আরনাউত্ব তাঁর ব্যাপারে মন্তব্য করেনঃ
তিনি সত্যবাদী, হাদীছ বর্ণনায় উত্তম ব্যক্তি, তাদলীস করেন, سمعت বা حدثنا না বললে সে বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হয় না, তাঁর ব্যাপারে বেশি ভুল করার মন্তব্য অতিরঞ্জিত
(
তাহরীর তাকরীবুত তাহযীবঃ ১১১৯ )

মাকহূল (রহঃ)প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিছতিনি সর্বসম্মতিক্রমে
ثقة فقيه تابعى كثير الارسال
নির্ভরযোগ্য, ফিক্বহের ইমাম, তাবেয়ী ও তার ইরসাল করা প্রসিদ্ধ

হাদীছটির অবস্থান নিয়ে পর্যালোচনাঃ
হাফিয মুনযিরী হাদীছটিকে আততারগীব ওয়াত-তারহীব এ এনেছেন, তিনি বলেনঃ
বাইহাকী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এটি একটি চমকার মুরসাল হাদীছ হাদীছটি অন্য সূত্রেও বর্ণিত আছেমাকহূল তা বর্ণনা করেছেনআবু ছালাবাহ (রঃ) থেকে সেটিও চমকার মুরসাল হাদীছ

সারকথাঃ
হাদীছটি মুরসাল, তবে গ্রহণযোগ্য, উত্তম মুরসালমুরসাল হানাফী ও মালেকীদের নিকট এমনিতেই গ্রহণযোগ্যجيد (উত্তম) হলে তো আরো ভাল কথাতাছাড়া এ হাদীছটি বহু হাদীছের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য ও আমলের ক্ষেত্রে সঠিক বলে সাব্যস্ত

আহলে হাদীস/সালাফী ভাইদের কাছে প্রশ্ন ও দাওয়াতঃ
উপরে বর্ণিত হাদীসটিই মুরসাল হাদীস এবং উত্তম মুরসাল যা হানাফী ও মালেকী ইমামদের নিকট এমনিতেই গ্রহণযোগ্য, উপরন্তু শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাবের মুরসাল হাদীস মানার পিছনে যে শর্ত আছে, তাও পূরণ করে
তাছাড়া হাদীসটার সমর্থনে আরও অনেক হাদীস থাকায় উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী এই হাদীস গুলো হাসান বা সহীহের পর্যায়ে চলে আসে
তাই আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তাহলে কেন আপনারা বার বার বলেন যে, শবে বরাতের ফযীলত নিয়ে কোন সহীহ হাদীস বা হাসান হাদীসও বর্ণিত নেই ??
এখন সালাফী বা আহলের হাদীসের ঐসব বন্ধুদের প্রতি দাওয়াত রইল, আপনারা আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ), শায়খ আলবানী (রহঃ) এর গবেষণা ও সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনআমি ওই সব ভাইদের কাছে বিনীতভাবে আরজ করতে চাই যে, আপনারা যদি শায়খ ইবনে বাযের (রহঃ) অনুসরণে বা নিজেদের তাহ্কীক মতো এই রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করতে পারেন তাহলে যারা উপরোক্ত মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের অনুসরণে উল্লেখিত হাদীসটির ভিত্তিতে এই রাতের ফযীলতের বিশ্বাস পোষণ করেন এবং সব ধরণের বেদআত রসম-রেওয়াজ পরিহার করে নেক আমলে মগ্ন থাকার চেষ্টা করেন তারাই এমন কি অপরাধ করে বসলেন যে, আপনাদেরকে তাদের পেছনে লেগে থাকতে হবে? এবং এখানকার উলামায়ে কেরামের দলীলভিত্তিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে অন্য একটি মত যা ভুলের সম্ভাবনার উর্ধ্বে নয়, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে তাদেরকে আলেম-উলামার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আস্থাহীন করা এবং বাতিলপন্থিদের মিশন সফল করতে সহায়তা দেওয়া কি সত্যিকার অর্থেই খুব বেশি প্রয়োজন? এতে তো কোন সন্দেহ নেই যে, আপনারা আপনাদের মতটিকে খুব বেশি হলে একটি ইজতেহাদী ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনাযুক্তই মনে করেন এবং নিশ্চয়ই আপনারা আপনাদের মতটিকে একেবারে ওহীর মতো মনে করেন নাএকটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন, এরপর আপনাদের এই অবস্থানের যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা আর থাকে কি না?
আপনাদের প্রতি আমার সর্বশেষ অনুরোধ এই যে, দয়া করে এ রাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) [মৃ. ৭২৮ হিঃ] এর ইক্তিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম/৬৩১-৬৪১ এবং ইমাম যায়নুদ্দীন ইবনে রজব (রহঃ) [মৃ. ৭৯৫] এর লাতায়েফুল মাআরেফ ১৫১-১৫৭ পড়ুন এবং ভেবে দেখুন যে, তাদের এই দলীলনির্ভর তাহকীক অনুসরণযোগ্য, না শায়খ ইবনে বায (রহঃ) এর একটি আবেগপ্রসূত মতামত? যা হয়ত তিনি শবে বরাত নিয়ে জাহেল লোকদের বাড়াবাড়ির প্রতিকার হিসেবেই ব্যক্ত করেছেনকিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে, বাড়াবাড়ির প্রতিকার কোন বাস্তব সত্য অস্বীকার করে নয়; বরং সত্য বিষয়টির যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে

শেষ কথাঃ
যদি অন্যান্য রাতের উপর এ রাতের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নাই থাকবে, তবে বিশেষভাবে এই রাতের কথা উল্লেখ করারই বা কি প্রয়োজন ? শুধু এই রাতকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মাধ্যমেই অন্যান্য রাতের উপর এর বিশেষত্ব প্রমাণিত হয়
উপরের হাদীস থেকে স্পষ্টতই এটা প্রমাণিত হয় যে, এ রাত্রে আল্লাহ পাক তাঁর বিপুল সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করেনযে রাত্রে আল্লাহ বিশেষভাবে ক্ষমার ওয়াদা করেছেন, সেই রাতে কাকুতি মিনতি করে তাঁর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে এটাই স্বাভাবিকআর আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া, তওবা করা বা যে কোন দোয়া করার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল কোন ভাল আমলের মাধ্যমে দোয়াটিকে শক্ত করা যাতে দ্রুত কবুল হয়বুখারী শরীফের তিন জন যুবকের কাহিনী হতে বিষয়টি স্পষ্ট হয় যারা পাহাড়ের গুহাতে আটকা পড়ে গিয়েছিলপরে একজনের পরামর্শে প্রত্যেকের ভাল আমল উল্লেখ করে দোয়া করলে আল্লাহ তাদের মুক্ত করেনতাছাড়া অনেক হাদীসেই নফল নামায পড়ে দোয়া করা, কোরআন তিলাওয়াত করে দোয়া করা, জিকির আযকার করে দোয়া করা ইত্যাদির প্রতি বিশেষভাবে উসাহিত করা হয়েছেসুতরাং মধ্য শাবানের এই রাতে আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষভাবে ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে সালাত, যিকির, কোরআন তিলাওয়াত করাও প্রমাণিত হয় এরপরও যদি কেউ বলে থাকেন যে, এই রাতে কোন ইবাদত করা যাবে না, তাহলে তা তার নিজের মনগড়া কথা বা প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়
এজন্যই বহু ইমামগণই এ রাতের নফল ইবাদত করাকে মুস্তাহাব বলেছেন এবং নিজেরাও বেশি বেশি ইবাদতে লিপ্ত ছিলেনযেমনঃ ইমাম শাফিঈ, ইমাম নববী, ইমাম বাযযার, ইমাম উকায়লী, ইমাম তিরমিযী (রহঃ) সহ আরও অনেকে যার বিবরণ সামনে আরও আসবে ইনশাল্লাহ
অতএব, যারা এ কথা বলে থাকেন যে, শবে বরাতের কোন ভিত্তি নেই, এর ফযীলত নিয়ে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত নেই, তারা রসূলের (সঃ) হাদীসের নামে মিথ্যাচার করেন এবং উম্মতকে রসূল (সঃ) এর সুন্নত ও নেক আমল থেকে দূরে সরে রাখানোই তাদের মূল উদ্দেশ্যতাদের এই হীন চক্রান্তকে আমরা ধিক্কার জানাই