মঙ্গলবার, ২৬ জুন, ২০১২

কুরআন-হাদীছের আলোকে শবে বরাত - পর্ব ০৯


بسم الله الرحمن الرحيم

হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ১
শবে বরাত সম্পর্কে বর্তমানের কিছু স্থূল দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে যে, শবে বরাত সম্পর্কীয় যেসব হাদীছ পাওয়া যায়, সেগুলো মওজু তথা মনগড়া ও জাল হাদীছএ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে তারা শবে বরাতের ফজীলতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বসেএমনকি এ রাতে জাগরণ থেকে ইবাদত-বন্দেগী, যিকির, তেলাওয়াতসহ সকল নফল ইবাদত করাকে বিদআত মনে করে

শবে বরাত সম্পর্কে হাদীছের কিতাবসমূহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে কিংবা হাদীছ শাস্ত্রে সম্যক ধারণা থাকলে একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তাদের এ
ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি অমূলক ও ভ্রান্ত এবং হাদীছ শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূতএমনকি তাদের এ ভ্রান্ত ধারণা শরীয়তের বিধানবলী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাহাবা ও তাবেয়ীন আইম্মায়ে মুজতাহেদীনসহ সকল সলফে সালেহীন এবং তাদের থেকে পরম্পরা সূত্রে প্রাপ্ত আমলের সাথে অসংগতি ও বিরোধপূর্ণ

মূলতঃ সাহাবায়ে কেরামের এক জলীলুল ক্বদর দল থেকে বিভিন্নসূত্রে শবে বরাতের ফজীলত সম্পর্কীয় বহু বর্ণনা হাদীছ গ্রন্থসমূহে বিদ্যমানযেসব বর্ণনার সূত্রগুলো কিছু সহীহ আর কিছু হাসান তথা সহীহের অন্তর্ভুক্ত আর কিছু জঈফ যা পরস্পর পরস্পরকে শক্তিশালী করে আমলের যোগ্য করে তোলে যদিও স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেকটি বর্ণনাকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করা যায় না, কিন্তু বেশ কিছু বর্ণনা ছ্বিকাহ রাবী তথা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত এবং তার অনুকূলে আরো রেওয়ায়েত বা হাদীছ বিদ্যমান থাকায় নিঃসন্দেহে তা সহীহ এর মানে উন্নীত হয়এই কারণেই শরীয়তে শবে বরাতের ফজীলত ভিত্তিহীন বলার কোন অবকাশ নেই

হাদীছ শাস্ত্রের কিছু নীতিমালাঃ
উপরোক্ত বিষয়গুলো বোধগম্য হওয়ার জন্য প্রথমে হাদীছ শাস্ত্রের কিছু নীতিমালা পেশ করা হচ্ছে


হাসান হাদীছঃ
ক)শবে বরাতের ব্যাপারে ( حسن ) হাসান স্তরের এমন কিছু হাদীছ তো অবশ্যই পাওয়া যায় যেসব হাদীছের সহযোগিতায় ও সমর্থনে অন্যান্য আরও হাদীছও বিদ্যমানআর হাদীছশাস্ত্রের মূলনীতি মতে হাসান স্তরের হাদীছের সমর্থনে ও সহযোগিতায় অন্য আরো রেওয়ায়েতে তথা বর্ণনা পাওয়া গেলে সেই হাদীছ হাসান স্তর থেকে উন্নীত হয়ে সহীহ স্তরের মর্যাদা লাভ করে

খ) যেমন এ প্রসঙ্গে হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী বলেনঃ
হাসান সনদ দ্বারা বর্ণিত হাদীছ হয় একটি হবে অথবা তার সমর্থনে অন্য হাদীছও থাকবেযদি মর্যাদার দিক থেকে উভয়টি সমান হয় কিংবা তার চেয়ে উচ্চস্তরের হয়, তাহলে বর্ণিত উভয় হাদীছ একে অপরের সমর্থনে সহীহ এর স্তরে পৌছে যায়

মুরসাল হাদীছঃ
মুরসাল হাদীস হল সেসব রেওয়ায়েত যেখানে একজন তাবেঈ সরাসরি রসূলের (সঃ) কোন কর্ম বা উক্তির বর্ণনা দেন, অর্থা কোন সাহাবা থেকে তিনি শুনেছেন তিনি তা উল্লেখ করেন নি

শবেবরাত সম্পর্কে কোন কোন হাদীছ মুরসাল ( مرسل ) পাওয়া যায়আর হানাফী মাযহাবসহ বহু ইমামগনের মতে মুরসাল হাদীছ সহীহ এবং শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য এখানে আমরা সংক্ষেপে মুরসাল হাদীস দলীল হওয়ার পক্ষে ইমামগণের মতামত উল্লেখ করব

ইমাম মালিক এবং মালিকি মাযহাবের সকল প্রসিদ্ধ ফকীহগণের মত হল, নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির মুরসাল হাদীস শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য এবং এর উপর আমল করা যাবে
(
তাজরীদ আল তামহীদ লিমা ফি আল মুয়াত্তা মিনাল আসানিদ, ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ ইবনে আবদুল বার, কায়রো, ১৩৫০, ১:২ )
তাদের কেউ কেউ আবার মুরসাল হাদীসকে মুসনাদ হাদীসের চেয়ে উত্তমও বলেছেন

ইমাম আবু হানিফাও ইমাম মালিকের মতই মুরসাল হাদীসকে সহীহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, চাই এর সমর্থনে অন্য কোন সহীহ হাদীস থাকুক বা না থাকুক
(
ইমাম সুয়ুতী )

ইমাম শাফিঈ মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য তাঁর কিতাব " আল রিসালাহ " তে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং কিছু শর্ত দিয়েছেনসেগুলো হলঃ
ক) এর সমর্থনে অন্য সনদে মুসনাদ হাদীস থাকতে হবে অথবা মুরসাল হাদীসের বক্তব্যের সাথে অধিকাংশ স্কলারদের মতের মিল থাকতে হবে খ) আর যে রাবী মুরসাল হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাকে উত্তম তাবেঈ হতে হবে
(
আল রিসালাহ, ইমাম শাফী, আহমদ শাখির এর সংস্করণ, কায়রো, ১৩৫৮/১৯৪০, পৃঃ৪৬১-৪৭০ )
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ) মুরসাল হাদীস গ্রহণ করেছেন যদি তার বিপরীতে কোন কিছুই পাওয়া না যায় এবং তিনি কিয়াসের চেয়ে মুরসাল হাদীসকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন
(
ইলাম আল মুয়াক্কিন, ইবনুল কায়্যিম, দ্বিতীয় সংস্করণ, দারুল ফিকর, বায়রুত, ১৩৯৭/১৯৭৭, ১:৩১ )
এজন্যই আল্লামা ইমাম নববী (রহঃ) বলেনঃ
মুরসাল হাদীছকে ইমাম মালেক (রহঃ) ও ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সহীহ এর শ্রেণীভুক্ত করেছেন
(
তাকরীবু লিন নববীঃ খ-১, পৃ-১৯৮ )

এ ব্যাপারে আল্লামা সাইফুদ্দীন আল আমেদী (রহঃ) বলেনঃ
মুরসাল হাদীছ এর গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে ইমামগণ মতবিরোধ করেছেনইমাম আবু হানিফা (রহঃ), ইমাম মালিক (রহঃ) ও ইমাম আহমদ (রহঃ) এর প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী উক্ত হাদীছ শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য
(
আল আহকাম ফি উসূলিল আহকামঃ খ-২, পৃ-১৭৭ )

আবু দাউদ (রহঃ) এর মতেও মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য, শর্ত হল, ঐ বিষয়ে কোন মুসনাদ হাদীস পাওয়া যাবে না, আর যদি যাই তাহলে তা মুরসাল হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না
(
সুরুত আল আইম্মাহ আল খামসাহ, আল হাজিমি, আল কাউসারী সংস্করণ, কায়রো, পৃ - ৪৫ )

১০ খতীব আল বাগদাদী (রহঃ)ও মুরসাল হাদীসকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন যদি তা উত্তম তাবেঈ থেকে বর্ণিত হয় অথবা তার সমর্থনে মুসনাদ হাদীস পাওয়া যায়
(
আল কিফায়া ফি ইলম আল রিওয়ায়াহ, খতীব বাগদাদী, হায়দারাবাদ, ১৩৫৭, পৃ - ৩৮৭ )

১১ ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ)ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী থেকে ইরসাল করা হলে সেই মুরসাল হাদীসকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন
(
মিনহাজ আল সুন্নাহ আন নববীয়াহ ফী নকদ কালাম আল শিয়া ওয়াল ক্বাদারিয়াহ, ইবনে তাইমিয়্যা, মাকতাবাহ আল আমিরীয়াহ, বুলাক, ১৩২২, ৪:১১৭ )
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ) মুরসাল হাদীসকে গ্রহণযোগ্য ও সহীহ বলে রায় দিয়েছেনআর ইমাম শাফিঈ গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য কিছু শর্ত দিয়েছেনউল্লেখ্য, শবে বরাতের মুরসাল হাদীস গুলো শর্তগুলো পূরণ করে

ফাযাইলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীসঃ

উপরন্তু হাদীছ বিশারদগণের মতে যঈফ তথা দুর্বল হাদীছ অত্যধিক দুর্বল না হলে ফাযাইলে আমাল এর ক্ষেত্রে তার উপর আমল করা যায়, এর ভিত্তিতে সওয়াবও পাওয়া যায় এবং উলামা মুহাদ্দিসদের এই বিষয়ে ইজমা আছেবড় বড় ইমাম এবং মুহাদ্দিসীনরা তাদের বিভিন্ন কিতাবে এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেনঅথচ শবে বরাত সম্পর্কীয় সকল হাদীছ যঈফ নয়

ইমাম বুখারী (রহঃ)
আমীরুল মুহাদ্দিসীন ইমাম বুখারী (রহঃ) হাদীসের উস্তাদ ছিলেন এবং স্পষ্টভাবেই সহীহ ও দুর্বল হাদীসের মধ্যে পার্থক্য জানতেনকিন্তু তবুও তিনি তার একটি ফাযাইলের কিতাবে দুর্বল হাদীস বর্ণনা করেছেনতার বিখ্যাত কিতাব " আল আদাব আল মুফরাদ ", এ কিতাবে প্রচুর যঈফ হাদীস রয়েছে, কিন্তু এটি জানার পরও কিতাবটি যুগ যুগ ধরে উম্মতরা পড়ে আসছে এবং অনুসরণ করে আসছে, কারণ এই কিতাবটিতে ফাযাইলের বর্ণনা আছেএমনকি এই কিতাবের কিছু অধ্যায়ে কোন সহীহ রেওয়ায়েতও নেই
আল্লামা শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ আদাব আল মুফরাদ এর সনদের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করছেন তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ " ফাযলুল্লাহ আস সামাদ " এ

ইমাম নববী (রহঃ)
ইমাম নববী (মৃঃ ৬৭৬ হিঃ) তার আল আযকারে যঈফ হাদীসের উপর আমল করার বিভিন্ন দিক আলোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ

কিছু কিছু ক্ষেত্রে (শর্তসাপেক্ষে) যঈফ হাদীসের উপর আমল করা যায়

মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফক্বিহ হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
"
সকলেই একমত যে যঈফ হাদীছ ফজিলত হাসিল করার জন্য আমল করা জায়েজ আছে।"
(
আল মওজুআতুল কবীর, ১০৮ পৃষ্ঠা)

ইমাম ইবনে হুমাম (রহঃ)
এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম ইবনে হুমাম রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
"
যঈফ হাদীছ যা মওজু নয় তা ফজিলতের আমল সমূহে গ্রহণযোগ্য"
(
ফতহুল ক্বাদীর)

ইমাম মুসলিম (রহঃ)
ইমাম আহমদ এবং সালাফের অন্যান্যদের মতের মত ইমাম মুসলিমও দুর্বল হাদীসকে প্রত্যাখান করেন নি
(
নববী, শরহে সহীহ মুসলিম (ভূমিকা); ইবনুল কায়্যিম, ইলাম আল মুওয়াক্কিন (১/৩১); ); সাখাবী, আল ক্বওল আল বাদী (পৃ-৪৭৪), ইবনে রজব, শরহে ইলাল আল তিরমিযী (১/৭৫-৭৬)

ইমাম ইবনে আরাবী (রহঃ)
ইমাম ইবনে আরাবী ফাযাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করেছেন
(
ইবনে আল আরাবী, আরিদাত আল আহওয়াযী (১০/২০৫); ফাতহুল বারী (১০/৬০৬) যা মুহাম্মদ আওয়ামা আল কওল আল বাদী (পৃ - ৪৭২) এ উল্লেখ করেন)

ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মঈন (রহঃ) ( ইমাম বুখারীর উস্তাদ)
তিনিও ফাযাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন
(
তাবীয়ুনাল আসার; ফাতহুল মাগহীত )

ইমাম আবু শামা মাকদীসী (রহঃ)
তিনি ফাযাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করেছেন এবং এটি মুহাদ্দিসীনদের সিদ্ধান্ত বলেও মত প্রকাশ করেছেন
(
তাওযীয়ুন নাদার)

১০ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ)
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ) তাঁর কিতাব " আল কায়দা আল জলীলা ফিত তাওয়াসসালি ওয়াল ওয়াসিলা ", মুহাক্কিক ড রাবিয়া বিন হাদী উমাইর আল মুযখালী, প্রফেসর, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা মুনাওয়ারাহ, এর ৮ম অধ্যায়ে যঈফ হাদীস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং অধিকাংশ উলামা কেরামের মতামত উল্লেখ করেছেন এবং সাথে নিজের মতও প্রদান করেছেন
ইবনে তাইমিয়্যা ৪৭৮ অনুচ্ছেদ (প্যারা) এ উল্লেখ করেনঃ

কোন আমল শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত থাকলে, এবং ফাযাইলের ক্ষেত্রে (এরকম আমলের) হাদীস বর্ণিত হলে একে মিথ্যা বলা যাবে না, এটা সম্ভব যে ফাযাইলটা সত্য, এবং কোন ইমামই দুর্বল হাদীস দ্বারা ফাযায়েলটিকে ওয়াজিব বা মুস্তাহাব বলেন নি, এবং যারা বলেছেন তারা ইজমার বিরুদ্ধে
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার কিতাব "আল কালিমুত তায়ীব" এ প্রচুর দুর্বল হাদীস রয়েছে যা পরবর্তীতে আলবানী "সহীহ আল কালিমুত তায়ীব" এবং "যঈফ আল কালিমুত তায়ীব" এ দুই ভাগে ভাগ করেন

১১ইমাম শাওকানী (রহঃ)
তাঁর মতে ফাযাইলের ক্ষেত্রে অনেক গুলো দুর্বল হাদীস এক করলে তা শক্তিশালী হয় এবং তার উপর আমল করা যায়
(
নায়লুল আওতার (৩/৬০))
তার বিখ্যাত কিতাব " তুহফাতুয যাকিরীন " এ প্রচুর পরিমাণে যঈফ হাদীস পাওয়া যায়

১৪ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহঃ) (মৃঃ ১৮১ হিঃ)
তাঁর মতে ফাযাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস বর্ণনা করা যায়
(
সুয়ুতীর তাদরীব আল রাবী)

১৫এ প্রসঙ্গে আল্লামা যফর আহমদ ওছমানীর রচিত গ্রন্থ ক্বাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীছ এর ভাষ্য নিম্নরূপঃ
দুররে মুখতার এ রয়েছে যে, ফাযাইলে আমাল এর ক্ষেত্রে যঈফ হাদীছ এর উপর আমল করা যাবেব্যাখ্যাকার ইবনুল আবেদীন বলেনঃ যে ফজীলত আমলের মাধ্যমে অর্জিত হয়, সেই ফজীলত লাভের উদ্দেশ্যে (যঈফ হাদীছ এর উপর আমল করা যাবে)
(
ক্বাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীছঃ পৃ - ৯২)

শবে বরাতের হাদীস এবং সাহাবীঃ
তাছাড়া শবে বরাতের সাথে সংশ্লিষ্ট হাদীছসমূহের বর্ণনাকারিদের মধ্যে অনেক বড় বড় (এক ডজনের মত ) সাহাবাও রয়েছেনযাদের কয়েকজনের পবিত্র নাম নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
ক) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রঃ)
খ) হযরত আলী (রঃ)
গ) হযরত আয়শা (রঃ)
ঘ) হযরত আবু হুরায়রা (রঃ)
ঙ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রঃ)
চ) হযরত আবু মুসা আশআরী (রঃ)
ছ) হযরত আউফ ইবনু মালিক (রঃ)
জ) হযরত মুআয ইবনু জাবাল (রঃ)
ঝ) হযরত আবু ছালাবাহ আল খুসানী (রঃ)
ঞ) কাছীর ইবনে মুররা আল হাজরমী (রঃ)


সার কথাঃ
এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কোন কথাই দুর্বল নয়মুহাদ্দিসীনে কিরাম হাদীসের ক্ষেত্রে সহীহ, হাসান, যঈফ ইত্যাদি যে পরিভাষা ব্যবহার করেন তা সনদ তথা বর্ণনাকারীগণের ধারাবাহিকতা ও গুণাগুণ বিবেচনায়উসূলে হাদীসের কিতাবে আছে- তিন কারণে হাদীস যঈফ হয়ে থাকে

১. বর্ণনাকারী ন্যায়পরায়ণতা, স্মরণশক্তি ও সংরক্ষণ ক্ষমতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমালোচিত হলে
২. বর্ণনাকারী অপরিচিত হলেকারণ এতে জানা যায় না তিনি নির্ভরযোগ্য কি না?
৩. বর্ণনাধারা (সনদ) মুত্তাসিল বা সংযুক্ত না হলেকারণ এতে জানা যায় না যে, মধ্যখান হতে যে বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েছে তিনি বিশ্বস্ত কি না?
মুহাদ্দিসীনে কিরাম হাদীস সংগ্রহ ও সংরক্ষণে বর্ণনাকারীদের সার্বিক গুণাবলীর চুল-চেরা বিশ্লেষণ করেন এবং সাথে সাথে সনদের সবলতা ও দুর্বলতার দিকটাও তুলে ধরেনসবলতা ও দুর্বলতা নির্ণয়ে সব মুহাদ্দিসীনের নীতি আবার এক নয়ইমাম বুখারী (রহঃ) হাদীস গ্রহণে যেরূপ কঠোর শর্তারোপ করেছেন অন্যরা তা করেন নিতাইতো দেখা যায় ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর বিবেচনায় যে সব হাদীস সহীহ, ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর বিবেচনায় তার কোন কোনটি সহীহ নয়স্বয়ং ইমাম মুসলিম (রহঃ) বলেন, যে সব হাদীস মুহাদ্দিসীনে কিরামের নিকট সহীহ ও নির্দোষ হিসেবে স্বীকৃত কিন্তু আমাদের আলোচিত ব্যক্তি (ইমাম বুখারী রহঃ)-এর নিকট যঈফ (দুবল) হিসেবে চিহ্নিত- যদি আমরা এগুলোর পরিপূর্ণ সংখ্যা হিসেব করার চেষ্টা করি তাহলে নিশ্চয়ই আমরা অসমর্থ হয়ে পড়বো এবং সবগুলোর আলোচনা করাটাও আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না (মুকাদ্দমায়ে সহীহ মুসলিম)

যাই হোক, মুহাদ্দিসীনে কিরাম তাদের অনুসৃত নীতির ভিত্তিতে হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে সবল হাদীসকে সবল এবং দুর্বল হাদীসকে দুর্বল বলে দিয়েছেন কিন্তু তারা এ কথা বলেন নি যে, দুর্বল হাদীস (যঈফ) কোন ক্ষেত্রেই গ্রহণীয় নয় মূলত দুর্বল হাদীস আমলের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় বলেই উলামা, মুহাদ্দিসীন ও মুফাসসিরীনে কিরাম তাদের স্ব স্ব কিতাবে ফযীলত ও আমলের বর্ণনায় এ ধরণের হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকেন নি শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত যে সকল হাদীসের সনদ দুর্বল এসব হাদীসতো সহীহ হাদীসের পাশাপাশি বিভিন্ন কিতাবে স্থান পেয়েছেএর দ্বারা শবে বরাতের সবিশেষ ফযীলত ও আমলের গুরত্বের দিকটাই প্রমাণিত হয়

উসূলে হাদীস সম্পর্কে যাদের ভাল ধারণা আছে, তার অবগত আছেন যে, হাদীসের দুর্বলতার মাত্রা সব সময় একই হয় না, কি কারণে হাদীসটি দুর্বল তার উপর হাদীসের দুর্বলতার মাত্রা এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম হয়ে থাকেযেমন কোন রাবীর স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণে একটি হাদীস দুর্বল, আর কোন রাবী মিথ্যুক এবং হাদীস জালকারী বলে সুপরিচিত, এজন্য একটি হাদীস দুর্বল - এই দুই ক্ষেত্রে দুর্বলতার মাত্রা কখনোই এক নয় হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী, যদি কোন ফাজাইলের ব্যাপারে অনেকগুলো হাদীস বা রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, এবং যদি তাদের মধ্যে অধিকাংশ রেওয়ায়েত দুর্বলও (কম মাত্রায়) থাকে, তবুও সবগুলো রেওয়ায়েতকে একত্রে করে সেই ফজীলত বা ফাজাইলকে গ্রহণ করা যাবে

সুতরাং যারা শবে বরাতের হাদীস সংক্রান্ত কিছু দলিলকে যঈফ হাদীছ বলে শবে বরাত পালন করা বিদায়াত বলে তাদের এধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভূল

শেষ কথাঃ
যেসব আহলে হাদীস বা সালাফী ভাইরা শবে বরাতের ফযীলতকে অস্বীকার করতে চান, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছিঃ
শবে বরাত সম্পর্কিত অনেক হাসান হাদীছ পাওয়া যায় যেগুলো উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী একে অপরকে শক্তশালী করে সহীহ এর পর্যায়ে চলে যায়
শবে বরাত সম্পর্কিত অনেক দুর্বল হাদীছ পাওয়া যায় যেগুলো বিভিন্ন সনদে বর্ণিত থাকায় উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী একে অপরকে শক্তশালী করে হাসান এর পর্যায়ে চলে যায়
তদুপরি মুহাদ্দিসে কেরামের ইজমা আছে যে, ফাজাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসের উপর আমল করা যায়

আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন উপরের তিনটি নীতিমালার কোনটিকে আপনারা অস্বীকার করছেন যে, যার ফলে আপনাদের কাছে শবে বরাতকে বিদয়াত মনে হয় এবং এর ফাযায়েলকে রীতিমত অস্বীকার করে চলেছেন?