রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১২

কঠোরতা কিংবা শিথিলতা নয়, মধ্যম্পন্থাই ইসলামে উত্তমপন্থা


------------আ স ম আহসান উল্লাহ আব্দুল্লাহ


মানুষের স্বভাব প্রকৃতিগতভাবেই দু’ ধরনের। কেউ সাহসী কেউ ভীতু। কেউ বেশি বোঝেন, কেউ কম বোঝেন। আমাদের চিরশত্রু শয়তান তাই প্রথমেই আমাদের মানসিক প্রকৃতির খোঁজ নিয়ে সেভাবেই আমাদেরকে ধোকা দিতে চায়।

আপনি হয়তো মন-মানসিকতায় সাধারণ মানের। আর আট/দশজনের মতোই আপনি ধর্মকে সহজভাবে ভালোবাসেন। আপনার এ অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে শয়তান আপনাকে প্ররোচিত করবে ।

ইসলাম তো আপনি মানবেনই, কিন্তু ধীরে ধীরে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে নয়। কি দরকার এতো তাড়াতাড়ির? আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হবেন। যাক না কয়েকটা দিন। আপনিও নিজের অজান্তে এ ভাবনাকে সায় দিয়ে ধীরে ধীরে এক সময় দূরে সরে যাবেন। প্রথমে সুন্নত ছেড়ে দিয়ে, তারপর ওয়াজিব, তারপর ফরজ নামাজগুলো, তারপর জুমার নামাজ, তারপর ঈদের নামাজ। এভাবে বাদ দিতে দিতে চলে আসবে আপনার নিজের জানাজার সময়।

আবার আরেকজন মন-মানসিকতায় দৃঢ়। তাকে সহজে ঘায়েল করা যাবে না। শয়তান তখন অন্য পথে হাঁটে। এ পথের নাম- ‘অতি ধার্মিকতার পথ’। ভেতরে ভেতরে তাকে উসকে দেবে, তোমার অজু হয়নি, কোনো অঙ্গ হয়তো শুকনো রয়ে গেছে, যাও আবার অজু করো। নামাজ মাত্র এ কয়েক রাকাত! আরে আরো বেশি করে আদায় করো। রোজা শুধু রমজান কেন, সারা বছর জুড়ে রাখো। রাতে ঘুম কেন, সারা রাত নামাজ পড়ো, তুমি পারবেই!

বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত, তিনজন যুবক একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘরে এসে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে খোঁজ নিলেন। কিন্তু রাসূলের ইবাদতের বর্ণনা শুনে তারা অবাক হয়ে গেলেন। তারা বলতে লাগলেন, ও তিনি তো নবী! আমরা তো আর নবীর মতো না। ইবাদত আমাদেরই করতে হবে
অনেক বেশি। একজন বললেন, ‘আমি আজ থেকে অনবরত রোজা রাখবো।’ আরেকজন বললেন, ‘আমি আজ থেকে আর রাতে ঘুমাবো না।’ আরেকজন তো আর বিয়েই করবেন না বলে শপথ নিলেন।

রাসূল এসে এসব শুনে বললেন, ‘আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভয় করি। তবুও আমি রোজা রাখি, আবার রোজা ছাড়াও থাকি। আমি নামাজও পড়ি আবার বিশ্রামের জন্য ঘুমাই। আমি বিয়েও করি। আমার এ আদর্শ থেকে যারা বিরত থাকবেন, তারা আমার উম্মত নন।’

এ শ্রেণীর মতো আমাদের সমাজেও কিছু লোক রয়েছেন, যারা নির্ধারিত ফরজ ইবাদতগুলোকে অল্প মনে করেন এবং ভাবেন, এ সামান্য ইবাদত দিয়ে কিছূ হবে না। তারা নিজেদের ইবাদতে আরো বেশি মগ্ন হয়ে এর সঙ্গে অনেক কিছু বাড়াতে চান। ওদিকে অন্যদের অধিকারের কথা বেমালুম ভুলে যান। আর এখানেই গোলমাল বাধে।

ইবাদতে অতি মগ্ন হতে গিয়ে তারা বিচ্যুত হন সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে, আর এর সঙ্গে বাড়াতে গিয়ে ছিটকে পড়ে যান ইবাদতের সীমানা ছাড়িয়ে। তার ইবাদত তখন উল্টো তার জন্য অশুভ পরিণাম বয়ে আনে।

এজন্যই মনীষীরা বলেন, আল্লাহপাকের প্রতিটি হুকুম নিয়ে শয়তান দু’ রকমের ফন্দি আঁটে। হয়তো বাড়াবাড়ি করিয়ে তা নষ্ট করা, নয়তো ছাড়াছাড়ি ঘটিয়ে তার মূলোৎপাটন করা। আর মানুষের স্বভাব বুঝে শয়তান সেভাবেই তাকে ঘায়েল করে। অতিমাত্রার বন্দেগি কিংবা অতিমাত্রার অবহেলা- এ দু’টি বিপজ্জনক সীমার মাঝামাঝি হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম।

ইবনুল কাইয়্যিম লিখেছেন, কেউ অবহেলা করতে গিয়ে অজু-নামাজ সব ছেড়ে দিলেন, আর কেউ বুজুর্গি হাসিল করতে গিয়ে ওয়াসওয়াসার রোগে আক্রান্ত হলেন।’ (ওয়াসওয়াসা বলার উদ্দেশ্য হলো, যারা সন্দেহবাতিক হয়ে তিনবারের জায়গায় সাতবার করেন। এক নামাজকে দোহরায়ে বারবার আদায় করেন।) কেউ তার ওপর ফরজ হওয়া যাকাতটুকুও আদায় করেন না, আবার অনেকে বেশি দান করতে গিয়ে সব সম্পদ আল্লাহর জন্য সদকা করে দিয়ে নিজে শেষ হতে বসে। কেউ হয়তো ইবাদতের বিঘ্নতার আশঙ্কায় বিয়েই করলেন না, আবার অনেকে খায়েশ মেটাতে গিয়ে হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়লেন। কেউ পরিবারকে উপোস রেখে মসজিদে আর দরগায় পড়ে থাকেন, আবার কেউ পরিবারের জন্য উপার্জনের দোহাই দিয়ে রোজা- নামাজ ছেড়ে দেন।’

এজন্যই আল্লাহর রাসূল হযরত হানজালাকে বলেছেন, ‘ধীরে..ধীরে.. ধাপে..ধাপে।। এই কথা দ্বারা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ‘আল্লাহর জন্য ইবাদতের পাশাপাশি তুমি তোমার স্ত্রী ও সন্তানকেও সময় দাও। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা ও হাসি গল্প করো। হালাল সীমানার ভেতরে থেকে আনন্দ হাসিতে বিনোদন করো। আবার নামাজের সময় হলে তুমি আল্লাহর জন্য সমর্পিত হও। এভাবে ধীরে ধীরে তুমি অভ্যস্ত হবে জীবনযাপনের, সর্বক্ষেত্রে তাকে স্মরণ রাখতে। একসঙ্গে এক দমকায় কেউ কখনো আল্লাহওয়ালা হতে পারেননি।

ইসলাম মানতে গিয়ে যে সত্যটি আমরা অহরহ ভুলে বসে থাকি, তা হচ্ছে- আল্লাহ আমাদেরকে যে দ্বীন দিয়েছেন তা ঠিক সেভাবেই মানতে হবে যেভাবে তিনি মানতে বলেছেন। এতে যিনি কিছু সংযোজন করলেন তার অপরাধ ঠিক ওই ব্যক্তির মতোই যিনি তা ছেড়ে দিলেন।

তাহলে আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে, এ বাড়াবাড়ি কিংবা নিজের জন্য কঠোরতা এবং ছাড়াছাড়ি বা শিথিলতার কারণ কি? এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, প্রবৃত্তির অনুসরণ। মনের চাহিদা মতো দ্বীন মানার প্রবণতা এবং এটাই শয়তানের মোক্ষম সুযোগ। মানুষ তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে করতে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হন, যখন তার শিরা-উপশিরা এবং নাড়ি-নক্ষত্রের চলনগতি প্রবৃত্তির চাহিদামতো হয়ে পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে কখনোই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব নয়।

তাই আমরা এই ধরনের বিপদ থেকে মুক্তি পেতে হলে, তার সমাধান খুজে বের করতে হবে, এবং সেই অনুযায়ি নিজেকে পরিচালনা করতে হবে। আর এর একমাত্র সমাধান হল সঠিক জ্ঞান লাভ। সঠিক জ্ঞান লাভ এবং এর প্রকৃত চর্চা না থাকলে কারো পক্ষেই সঠিক বৃত্তে অবস্থান সম্ভব নয়। আমলবিহীন ইলম এর কারণে অনেকেই শেষ পর্যন্ত মুনাফিক হয়ে যান। আবার ইলম বিহীন আমল করতে গিয়ে মানুষ জড়িয়ে যাচ্ছেন বিদআত ও ভ্রান্তির বেড়াজালে।

সূরা নামলের ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘শয়তান তার কাজকর্মগুলোকে তাদের কাছে সুন্দর করে উপস্থাপন করে, এভাবেই সে তাদেরকে সঠিক পথ থেকে সরিয়ে দেয়। আর কখনোই তারা পথপ্রাপ্ত হয় না।’

আরেকটি আয়াতে আল্লাহ পাক সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘আমি কি বলে দেবো, কারা ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারী? যাদের সব প্রচেষ্টা (আমল ও ইবাদত) দুনিয়াতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা ভাবছে, তারা খুব পুণ্যের কাজ করে যাচ্ছে।

ঘরে বসে থাকলে যেমনি ইসলাম ও দ্বীন কায়েমের বাস্তবতা হাসিল করা যাবেনা, ঠিক তেমনি মারা-মারি, খুন-খারাবী, লুট-পাট ও জ্বালাও-পোড়াও করেও দ্বীনের স্বার্থকতা হাসিল অসম্ভব। আমাদের দ্বীন, আমাদের সার্বিক ইবাদতে আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ও ভালোবাসা নিহিত থাকা অনিবার্য ও জরুরী কারন ইসলামে উদারতা ও সরলতা এবং মধ্যমপন্থার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর জীবন ও আদর্শের অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। আর তাই, কোনো অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ নয়, একমাত্র কুরআন ও হাদীসের নিদের্শনার সঠিক মর্ম অনুধাবন ও আমলই এর সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম সমাধান।

তাই মুসলমান হিসাবে আমাদের উচিত- ইসলাম নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি না করে এবং কোন কোন বিষয়ে বেশী চুপ না থেকে, ইসলাম স্বীকৃত নানা কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে ও ইসলামের আদর্শ দিয়ে দ্বীনের কাজ করা।

মহান আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা যেনো আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করেন। আমীন।